প্র : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবে, কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
উ : ২৬.৯.১৮২০; মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে।
প্র : তাঁর পৈতৃক পদবি কী?
উ : বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্র : কোন প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দেয়া হয়?
উ : সংস্কৃত কলেজ থেকে।
প্র : তিনি কোন নামে স্বাক্ষর করতেন?
উ : ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা।
প্র : তিনি মূলত কী ছিলেন?
উ : সমাজসংস্কারক (বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য খ্যাত), লেখক, শিক্ষাবিদ।
প্র : তাঁর পিতার নাম কী?
উ : ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্র : ঈশ্বরচন্দ্রের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কতটুকু?
উ : গ্রামের পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে কলকাতার সরকারি সংস্কৃত কলেজে ভর্তি এবং একাদিক্রমে বারো বছর অধ্যয়ন। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, স্মৃতি, ন্যায় ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন।
প্র : তিনি কত সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের হেড পন্ডিত পদে নিযুক্তি লাভ করেন?
উ : ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর।
প্র : তিনি সংস্কৃত কলেজে যোগ দেন কত সালে?
উ : ১৮৪৬ সালের ৬ই এপ্রিল।
প্র : তিনি জনশিক্ষা ও শিশুশিক্ষা প্রসারকল্পে বাঙালির জন্য কী কী গ্রন্থ রচনা করেন?
উ : বোধোদয় (১৮৫১), বর্ণপরিচয় ১ম ও ২য় ভাগ (১৮৫৫), কথামালা (১৮৫৬), আখ্যান মঞ্জুরী (১৮৬৩)।
প্র : বিদ্যাসাগরের কয়েকটি মৌলিক রচনার পরিচয় দাও।
উ : অতি অল্প হইল, আবার অতি অল্প হইল, ব্রজবিলাস, বিধবা বিবাহ ও যশোরের হিন্দু ধর্মরক্ষিণী সভা, রতœ পরীক্ষা। এই পাঁচটি বেনামি রচনা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। ‘কস্যাচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ নামে প্রথম রচনা ‘অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩)। উক্ত বেনামিতে দ্বিতীয় রচনা ‘আবার অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩)। এই বই দুটি বহুবিবাহ বিষয়ে তারানাথ তর্কবাচস্পতির লিখিত বক্তব্যের প্রতিবাদে লেখা, বিতর্কমূলক উত্তর-প্রত্যুত্তর। তৃতীয় রচনা ‘ব্রজবিলাস’ (১৮৮৫) ‘কবিকুল তিলকস্য বস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ বেনামিতে লেখা, নবদ্বীপের ব্রজনাথ বিদ্যারতেœর বিধবা বিবাহ বিরোধী সংস্কৃত বক্তৃতাবলির উত্তর। চতুর্থ রচনা ‘বিধবা বিবাহ ও যশোরের হিন্দু ধর্ম রক্ষিণী সভা’ (১৮৮৪), ‘কস্যচিৎ তত্ত্বাষ্কেষিণ’ বেনামিতে বিদ্যারতœ, ন্যায়রতœ ও স্মৃতিরতœ উপাধিধারী তিন পন্ডিতের যথার্থ পরিচয় দেওয়ার উদ্দেশ্যে। পঞ্চম রচনা ‘কস্যাচিৎ উপযুক্ত ভাইপো-সহচরস্য’ বেনামিতে লেখা ‘রতœপরীক্ষা’ (১৮৮৬)। এতে ভাষা নির্মাণে বিদ্যাসাগর সাধুরীতিকে কথ্যরীতিতে নিয়ে এসেছেন।
প্র : ‘শকুন্তলা’ গ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : প্রাচীন সংস্কৃত মহাকবি কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তল্ম’ নাটক অবলম্বনে ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একটি আখ্যান বা উপন্যাসোপম কাহিনি লিখে নাম দেন ‘শকুন্তলা’। ‘শকুন্তলা’য় কাহিনি নির্মাণ ও ভাষাব্যবহারে বিদ্যাসাগর যথেষ্ট স্বাধীনতা নিয়েছেন। এখানে লেখকের সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি, আধুনিক মনোভাব, শিল্প ও পরিমিতিবোধ প্রকাশিত। চন্দ্রবংশীয় রাজা দুষ্মন্ত শিকারে এসে কম্ব মুনির তপোবনে উপস্থিত হয়। সেখানে শকুন্তলা, প্রিয়ংবদা, অনসূয়া নামের মুনির তিন রূপবতী পালিতা কন্যার মধ্যে শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্মন্তের বিয়ে হয়। দুষ্মন্ত চিহ্ন হিসেবে রাজ-আংটি শকুন্তলাকে দিয়ে নিজ রাজ্যে চলে আসে। রাজকার্যে ব্যস্ত দুষ্মন্ত শকুন্তলার কথা ভুলে যায়। এদিকে শকুন্তলার গর্ভে এক পুত্র সন্তান জন্ম নেয়; নাম ভরত। ভরতসহ শকুন্তলা রাজা দুষ্মন্তের প্রাসাদে এসে তাদের বিয়ের কথা বর্ণনা দিলেও রাজা তা মনে করতে পারে না। পরে দৈববাণীতে দুষ্মন্ত সব অবগত হয় এবং শকুন্তলা-ভরতকে যোগ্য স্থান দেয়। বৃদ্ধ বয়সে দুষ্মন্ত ভরতকে নিজ রাজ্যের উত্তরাধিকারী করে। বাংলা সাহিত্যে ‘শকুন্তলা’ গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এ গ্রন্থের আগে গদ্যে রচিত এতো চমৎকার কাহিনি বা আখ্যান বর্ণনা পাওয়া যায় না। গদ্যসাহিত্য প্রতিষ্ঠার যুগে ‘শকুন্তলা’ একটি অসাধারণ সৃষ্টি।
প্র : তিনি কত সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো এবং কত সালে তত্ত্ববোধনী সভার সভা হন?
উ : ১৮৫৬ ও ১৮৫৮ সালে।
প্র : তিনি কোন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন?
উ : বিধবা-বিবাহ আন্দোলন।
প্র : ‘বিধবা-বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ করেন কত সালে?
উ : ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে।
প্র : কত সালে বিধবা বিবাহ আইনে পরিণত হয়?
উ : ২৬শে জুলাই, ১৮৫৬।
প্র : তাঁর কোন নিকটাত্মীয় বিধবা বিবাহ করেন?
উ : তাঁর পুত্র নারায়ণচন্দ্র ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে বিধবা বিবাহ করেন।
প্র : ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকার নাম কী?
উ : বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার।
প্র : ‘অতি অল্প হইল’ কত সালে রচিত?
উ : মে ১৮৭৩; ‘কস্যচিত উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে।
প্র : তিনি কী হিসেবে খ্যাত?
উ : বাংলা গদ্যের জনক।
প্র : বাংলা গদ্যপ্রবাহ সমৃদ্ধির জন্য তিনি তাঁর গদ্যে কীসের সৃষ্টি করেন?
উ : ‘উচ্চবচন ধ্বনিতরঙ্গ’ ও ‘অনতিলক্ষ্য ছন্দঃস্রোত’।
প্র : বাংলা গদ্যে যতি বা বিরামচিহ্ন প্রথম স্থাপন করেন কে?
উ : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
প্র : বিদ্যাসাগর বিশুদ্ধসাহিত্যগুণসম্পন্ন পুস্তক রচনার অবাকাশ পান নি কেন?
উ : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অতিদ্রুত বাংলা ছাত্রপাঠ্য গ্রন্থের অভাব দূর করা। তাই শিক্ষাবিদ বিদ্যাসাগর ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলায় গ্রন্থ অনুবাদে রত হয়েছিলেন। তাঁর এই প্রয়াসও ছিল শিক্ষার প্রসার এবং সমাজসংস্কারমূলক কার্যের অন্তর্ভুক্ত। সেইজন্য নিছক রসচর্চা ছেড়ে দিয়ে নিজরে সারস্বত প্রতিভাকে তিনি অনুবাদকর্মে নিয়োগ করেছিলেন।
প্র : ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা গদ্যের জনক-মন্তব্যটির যাথার্থ্য সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
উ : বাংলা গদ্যকে গতিশীল করে প্রাণদান করেছেন বিদ্যাসাগর। এর আগে তা ছিল প্রস্তরবৎ। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিতগোষ্ঠী ও রামমোহন রায়ের বাংলা গদ্যরচনার প্রাথমিক প্রয়াস অবশ্যই প্রশংসনীয়। তাঁদের গদ্যরীতিতে বহুতর অপূর্ণতার লক্ষণ ছিল স্পষ্ট। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বাংলা গদ্যে কিছুটা ছন্দ আনলেও সে গদ্য দূরান্বয়ী দোষ থেকে গেছে। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যে সুললিত শব্দবিন্যাস, পদবিভাগ ও যতিসন্নিবেশে সুবোধ ও শিল্প গুণান্বিত করে তোলেন। বাংলা গদ্যের অন্তর্নিহিত ধ্বনিঝংকার ও সুরবিন্যাস তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন এবং বাংলা গদ্যকে শ্বাসপর্ব ও অর্থপর্ব অনুসারে ভাগ করে সেখানে যতিচিহ্ন স্থাপন করেন। বিদ্যাসাগরের পরিকল্পিত সাধুভাষা তাই পরবর্তীকালের আদর্শ সাধুভাষা রূপে গৃহীত হয়। বাংলা গদ্যকে তিনি সাহিত্য গুণসম্পন্ন ও সর্বভাব প্রকাশক্ষম করেছিলেন বলেই বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের জনক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের ‘প্রথম শিল্পী’ বলে অভিহিত করেছেন।
প্র : বিদ্যাসাগরের কয়েকটি বিখ্যাত গদ্যগ্রন্থের নাম কী?
উ : ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (হিন্দি বৈতালপৈচ্চিসির বঙ্গানুবাদ ১৮৪৭) ‘শকুন্তলা’ (কালিদাসের অভিজ্ঞানম শকুন্তলম নাটকের উপাখ্যান ভাগের বঙ্গানুবাদ, ১৮৫৪), ‘সীতার বনবাস’ (ভবভূতির উত্তররাম চরিত নাটকের প্রথম অঙ্কের ও রামায়ণের উত্তর কান্ডের বঙ্গানুবাদ, ১৮৬০), ‘ভ্রান্তিবিলাস’ (শেক্সপিয়রের Comedy of Errors-এর বঙ্গানুবাদ, ১৮৬৯)।
প্র : বিদ্যাসাগরের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ কোনটি?
উ : বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭)।
প্র : বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক গদ্য রচনার নাম কী?
উ : প্রভাবতী সম্ভাষণ (১৮৯২)।
প্র : বিদ্যাসাগর রচিত ব্যাকরণগ্রন্থের নাম কী?
উ : ব্যাকরণ কৌমুদী।
প্র : ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন?
উ : মানবতাবাদ, কর্মবাদ ইহলৌকিক চিন্তা চেতনার প্রতি আস্থাশীল একজন ক্ষণজন্মা বাঙালি।
প্র : বিবিসি জরিপকৃত (২০০৪) সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় তাঁর স্থান কোথায়?
উ : অষ্টম স্থান।
প্র : তিনি কী কী পুরস্কার লাভ করেন?
উ : বিদ্যাসাগর উপাধি (১৮৩৯), বাংলার গভর্নর কর্তৃক সম্মাননা লিপি (১৮৭৭) ও ভারত সরকার কর্তৃক সিআইই উপাধিতে ভূষিত।
প্র : তাঁর মৃত্যু তারিখ কত?
উ : ২৯.৭.১৮৯১।