যে সমাসে পূর্বপদটি পরপদের বিশেষণ রূপে অবস্থান করে এবং পরপদের অর্থই কার্যকরী থাকে তাকে কর্মধারয় সমাস বা Appositional Determinatives বলে। কর্মধারয় শব্দের অর্থ বৃত্তি ধারণকারী। বিশেষণ ও বিশেষ্য, বিশেষ্য ও বিশেষণ, বিশেষণ ও বিশেষণ এবং বিশেষ্য ও বিশেষ্য- এই রকম সম্পর্ক নিয়ে কর্মধারয় সমাস হয়।
বিশেষণ ও বিশেষ্য (পূর্বপদ বিশেষণ ও পরপদ বিশেষ্য)
কাল যে পেঁচা-কালপেঁচা গুণী যে জন-গুণীজন
নীল যে মানিক-নীলমানিক হেড যে মাস্টার-হেডমাস্টার
লার যে টুপি-লালটুপি ভাঙা যে হাট-ভাঙাহাট
পূর্ব যে রাত্র-পূর্বরাত্র সতী যে রমণী-সতীরমণী
নব যে পল্লব-নবপল্লব দুষ্ট যে মতি-দুষ্টমতি
শ্বেত যে বস্ত্র-শ্বেতবস্ত্র নীল যে উৎপল-নীলোৎপল
সৎ যে কর্ম-সৎকর্ম মধুর যে বচন-মধুরবচন
অনুরূপ: পুণ্যভূমি, পুণ্যদিন, মহর্ষি, মোহনভোগ, মহাজন, পূর্বাহ্ন, অপরাহ্ন, ভাল মানুষ, প্রিয়পাত্র, নবজাতক, বড়লাট, গতকাল, শ্বেতপদ্ম, খোদমেজাজ, দীর্ঘায়ু, খাসমহল ইত্যাদি।
বিশেষণ ও বিশেষণ (পূর্বপদ ও পরপদ উভয়ই বিশেষণ হয়)
যেমন-
যে চালাক সে চতুর-চালাকচতুর যা টাটকা তা ভাজা-টাটকা ভাজা
যা কাঁচা তাই মিঠা-কাঁচামিঠা সাড়ে এর সাথে পাঁচ-সাড়েপাঁচ
যা বিরাট তা বিশাল-বিরাটবিশাল যা লাল তা কালো-লালকালো
মধুর অথচ ভীষণ- মধুরভীষণ যেমন হিংস্র তেমন কুটিল-হিংস্রকুটিল
কঠিন অথচ কোমল-কঠিনকোমল
বিশেষ্য ও বিশেষ্য
যেমন-
যিনি ঠাকুর তিনি দাদা-ঠাকুরদাদা যিনি খোকা তিনি বাবু-খোকাবাবু
যিনি খাঁ তিনি সাহেব-খাঁ সাহেব যিনি পিতা তিনি দেব-পিতৃদবে
যিনি মৌলবী তিনি সাহেব-মৌলবী সাহেব যিনি গঙ্গা তিনি নদী-গঙ্গানদী বা গঙ্গা নামের নদী
অনুরূপ: অশোকপুষ্প, আকাশমন্ডল, ললাটভাগ, তমাললতা, পন্ডিতজন, ঢাকানগরী, দাদাভাই, শুকতারা ইত্যাদি।
মধ্যপদলোপী কর্মধারয়: যেখানে কর্মধারয় সমাসে ব্যাসবাক্যের মধ্যে অবস্থিত ব্যাখ্যামূলক পদের লোপ পায় তাকে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস বলে। উদাহরণ-
ঘি মেশানো ভাত-ঘিভাত স্বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল অক্ষর-স্বর্ণাক্ষর
দুধ মিশ্রিত সাগু-দুঘসাগু পদ্ম সদৃশ আঁখি-পদ্ম-আঁখি
তেল মাখার ধুতি-তেলধুতি সিঁদুর রাখার কৌটা-সিঁদুরকৌটা
ঘৃত মিশ্রিত অন্ন-ঘৃতান্ন শিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী-শিক্ষামন্ত্রী
পল সহযোগে অন্ন-পলান্ন খাদ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়-খাদ্যমন্ত্রণালয়
অষ্ট অধিক দশ-অষ্টাধিক পদার্থ বিষয়ক বিদ্যা-পদার্থবিদ্যা
অনুরূপ: উটপাখি, মানিব্যাগ, ষোড়শ, ভিক্ষান্ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব, জয়পতাকা, মোটরগাড়ি, সিংহাসন, একাদশ, দ্বাদশ।
তুলনা বা উপমা করে কর্মধারয় সমাস হয়: এর তিনটি ভাগ রয়েছে। একে তুলনাবাচক কর্মধারয় সমাস বলা যেতে পারে।
এগুলো হলো- ক. উপমান কর্মধারয় খ. উপমিত কর্মধারয় ও গ. রূপক কর্মধারয়। এই তিন প্রকার সমাসে তিনটি উপাদান থাকে- (ক) উপমান (খ) উপমেয় (গ) সাদৃশ্যবাচক শব্দ।
উপমান: যার সাথে তুলনা করা হয় তাকে উপমান বলে। চাঁদের মতো মুখ-চাঁদমুখ। এই ব্যাসবাক্যে চাঁদের মাসে মুখের তুলনা করা হয়। এখানে চাঁদ উপমান।
উপমেয়: যাকে তুলনা করা হয় তাকে উপমেয় বলে। ওপরের ব্যাসবাক্যে মুখ উপমেয়।
সাদৃশ্যবাচক ও বা তুলনাবাচক শব্দ: ওপরের ব্যাসবাক্যে ‘মতো’ হল সাদৃশ্যবাচক বা তুলনাবাচক শব্দ। অনুরূপভাবে ন্যায়, সদৃশ্য ইত্যাদি শব্দও ব্যবহার করা হয়।
উপমিত কর্মধারয়: পূর্বেপদে উপমান ও পরপদে উপমিত মিলে যে সমাস হয় তাকে উপমিত কর্মধারয় বলে। এখানে উপমান ও উপমেয় দুটোই বিশেষ্য পদের হয়। যেমন-
সোনার মতো মুখ- সোনামুখ (বিশেষ্য+বিশেষ্য)
পদ্মের ন্যায় মুখ-পদ্মমুখ
সিংহের ন্যায় নর-নরসিংহ
কমলের ন্যায় নয়ন-নয়নকমল
চাঁদের ন্যায় বদন-চাঁদবদন
অনুরূপ: অধরপল্লব, চরণকমল, বীরসিংহ, ফুলঝুরি, পুরুষ ব্যাঘ্র, রাজর্ষি, পুঙ্গব, করপল্লব।
উপমান কর্মধারয়: পূর্বপদে উপমান ও পরপদে সাধারণ গুণবাচক বিশেষণ মিলে যে সমাস হয় তাকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে। এক্ষেত্রে বিশেষ্য ও বিশেষণের মধ্য সমাস হয়। যেমন-
কুসুমের ন্যায় কোমল-কুসুমকোমল (বিশেষ্য+বিশেষণ)
শশকের ন্যায় ব্যস্ত-শশব্যস্ত তুষারের ন্যায় ধবল-তুষারধবল
বরফের মত সাদা-বরফসাদা মিশির ন্যায় কালো-মিশকালো
লৌহের ন্যায় কঠিন-লৌহকঠিন গোলাপের মত লাল-গোলাপলাল
কুসুমের মত পেলব-কুসুমপেলব সিঁদুরের মত লাল-সিঁদুরলাল
আরো উদাহরণ: শৈলোন্নত, দূর্বাদলশ্যাম, ঘনশ্যাম (ঘন অর্থ মেঘ), গোবেচারা, হিমশীতল ইত্যাদি।
রূপক সমাস: পূর্বপদে উপমেয় ও পরপদে উপমানের (বিশেষ্য+বিশেষ্য- মধ্যে অভেদ কল্পনা করে যে সমাস হয় তাকে রূপক সমাস বলে। যেমন- কাল রূপ রাত্রি-কালরাত্রি। এখানে উপমান ও উপমেয়র সম্পর্ক অভেদ বা অভিন্ন মনে হয়। ‘কাল’ এখানে উপমেয় এবং ‘রাত’ উপমান। যেমন-
জ্ঞান রূপ আলোক-জ্ঞানালোক বিরূহ রূপ সাগর-বিরূহসাগর
ভব রূপ নদী-ভবনদী আঁখি রূপ পাখি-আঁখিপাখি
মন রূপ মাঝি-মনমাঝি চাঁদ রূপ বদন-চাঁদবদন
বিদ্যা রূপ ধন-বিদ্যাধন ক্ষুধা রূপ অনল-ক্ষুধানল
এরকম: কালচক্র, জীবনপ্রবাহ, শোকসাগর, দেশমাতৃকা, প্রাণপাখি, বিষাদসিন্ধু, শোকসিন্ধু, দেশমাতৃকা, সংসার সমুদ্র, মোহনিদ্রা ইত্যাদি।
তথ্যসূত্র: পুরাতন বইয়ের দোকান/লাইব্রেরি হতে বিভিন্ন লেখকের বাংলা ব্যাকরণ বই সংগ্রহ করে তা এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।