প্র : জীবনানন্দ দাশের জন্ম সাল কত?
উ : ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯।
প্র : তাঁর জন্মস্থান কোথায়?
উ : বরিশাল।
প্র : তাঁর আদি নিবাস কোথায়?
উ : গাওপাড়া গ্রাম, বিক্রমপুর।
প্র : তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কতটুকু?
উ : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম.এ (১৯২১)।
প্র : জীবনানন্দ দাশ কোন পত্রিকার সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করেন?
উ : দৈনিক স্বরাজ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগ।
প্র : তাঁর রচনায় কী কাব্যময় হয়ে উঠেছে?
উ : গ্রাম বাংলা ঐতিহ্যময় প্রকৃতি।
প্র : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে কী বলেছেন?
উ : চিত্ররূপময় কবিতা।
প্র : তাঁর রচিত কবিতায় কী কী দীপ্যমান?
উ : আধুনিক নাগরিক জীবনের হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বিষাদ ও সংশয়ের চিত্র।
প্র : তিনি স্মরণীয় ও বরণীয় কেন?
উ : স্বচ্ছ, সুন্দর, শান্ত ও ¯িœগ্ধ রোম্যান্টিক কবিতার স্রষ্টা বলে।
প্র : বিশ শতকের ষাটের দশকের বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশে আন্দোলনে ও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে কী তীব্রভাবে এদেশের সংগ্রামী জনতাকে অনুপ্রাণিত করেছেন?
উ : তাঁর নিসর্গ বিষয়ক কবিতা।
প্র : তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলো কী?
উ : ঝরাপালক (১৯২৮), ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), রূপসী বাংলা (১৯৫৭) ও বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)।
প্র : জীবনানন্দ দাশকে কী কী বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়।
উ : ধূসরতার কবি, তিমির হননের কবি, নির্জনতার কবি, রূপসী বাংলার কবি।
প্র : জীবনানন্দ দাশের কবিতায় চিত্ররূপময়তার পরিচয় দাও।
উ : জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে কবিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠিতে লিখেছিলেন? তোমার কবিতা চিত্ররূপময়; তাতে তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে। রবীন্দ্রনাথের এই পর্যবেক্ষণ ভুল নয়। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ছবির পর ছবি দেখা যায়। এই ছবি কোনো সাদা-কালো ছবি নয়, যেন রঙিন চলচ্চিত্র। তিরিশের আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দই এই গুণে গুণান্বিত ছিলেন। উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, যেমন: ‘চারিপাশে বনের বিস্ময় / চৈত্রের বাতাস / জ্যোৎ¯œার শরীরের স্বাদ যেন; / ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে; / কোথাও অনেক বনে- যেইখানে জ্যোৎ¯œা আর নাই / পুরুষহরিণ সব গুনিতেছে শব্দ তার।’ (-ক্যাম্পে) অথবা অন্য একটি কবিতায় : ‘হাতে তুলে দেখি নি কি চাষার লাঙল? / বালতিতে টানিনি কি জল? / কাস্তে হাতে কতোবার যাই নি কি মাঠে? / মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে / ঘুরিয়াছি;’। (-বোধ) এই দুটি উদ্ধৃতিতেই কবিতা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের চোখে একটি করে রঙিন ছবি ভেসে উঠবে। জীবনানন্দ দাশের কবিতাতকে এ কারণেই চিত্ররূপময় বলা হয়।
প্র : জীবনানন্দ দাশকে ধূসরতার কবি বলা হয় কেন?
উ : ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ (১৯৩৬) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ আছে জীবনানন্দ দাশের। কিন্তু শুধু এ কারণেই তাঁকে ‘ধূসরতার কবি’ বলা হয়- তা নয়। ঝরা পাতা, শিরশিরে হাওয়া, উর ব্যাবিলন মিশরীয় সভ্যতা- এসবই জীবনানন্দের কাব্য-বৈশিষ্ট্য। বন্ধ্যাযুগের যথাযথ চিত্রকল্প সৃষ্টিতে জীবনানন্দের তুলনা নেই। মৃত্যুচেতনাও প্রায় প্রথম থেকেই তাঁর কবিতায় দেখা যায়। শ্মশান, মরুবালু, আলেয়া ইত্যাদি কবিতার পটভূমি মৃত্যু। এই মৃত্যুচেতনা গধষধফু ড়ভ ঃযব ধমব অর্থাৎ যুগযন্ত্রণা থেকে উদ্ভূত। জীবনানন্দ একে জীবনে ধারণ করেছিলেন। যেমন, একটি কবিতায় তিনি হতাশা ভরে বলেছেন: ‘বিবর্ণ জ্ঞানের রাজ্য কাগজের ডাঁইয়ে পড়ে আছে, / আমাদের সন্ততিও আমাদের নয়।’ (-বিনন্ন কোরাস) এরকমের হতাশা আর বিবর্ণের কথা আছে তাঁর বহু কবিতায়। তাঁর কবিতার চালচিত্রে আছে ধূসর বর্ণ। তাই জীবনানন্দ দাশকে ধূসরতার কবি বলা হয়।
প্র : জীবনানন্দ দাশের কবিতা যেন উপমার জাদুঘর। তাঁর কবিতা থেকে কয়েকটি উপমার উল্লেখ কর।
উ : সংস্কৃত সাহিত্যে ‘উপমা কালিদাশস্য’ বলে একটি কথা আছে। বাংলা কবিতায় বলতে হয়: ‘উপমা জীবনানন্দ দাশস্য’। সত্যিকার অর্থেই জীবনানন্দ দাশের কবিতা যেন উপমার জাদুঘর। নিচে কয়েকটি উপমার উল্লেখ করা হলো:
* আতার ক্ষীরের মতো সোহাগ সেথায় ঘিরে আছে।
* তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার স্লান চোখ মনে আসে।
* নীল আকাশে খই ক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা।
* পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
* উটের গ্রীবার মতো কোন-এক নিস্তব্ধতা এসে।
বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশের কবিতায় উপমা প্রয়োগ নিয়ে মন্তব্য করেছেন: ‘তাঁর উপমা উজ্জ্বল, জটিল ও দূরগন্ধবহ।’ অর্থাৎ জীবনানন্দ দাশের কবিতায় উপমা কেবল চিত্র বা তুলনা নয়, তারা
চিন্তা। কথাটি অসঙ্গত নয়।
প্র : তাঁর রচিত প্রবন্ধগ্রন্থ কোনটি?
উ : কবিতার কথা।
প্র : তিনি বিশিষ্ট কেন?
উ : রবীন্দ্রবলয় ছিন্নকারী ও উত্তরকালের কবিদের উপর সর্বাপেক্ষা অধিক প্রভাববিস্তারী কবি হিসেবে। তাছাড়া মর্মগত, সুমিত, নিরাবেগ ও সুস্থির গদ্য লেখক হিসেবেও।
প্র : তাঁর রচিত উপন্যাসগুলো কী কী?
উ : মাল্যবান (১৯৭৩), সতীর্থ (১৯৭৪)।
প্র : ‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থের পরিচয দাও।
উ : ‘ঝরাপালক’ (১৯২৭) জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুসরণ যেমন আছে, তেমনই আছে এক নতুন ভাষারীতি ও বাকপ্রতিমা রচনার চেষ্টা।
প্র : ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের পরিচয দাও।
উ : ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ (১৯৩৬) জীবনানন্দ দাশের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এই কবিতাগুলির মধ্যে জীবনানন্দীয় কাব্যের নিজস্ব বিষয়, ছন্দভঙ্গি, ভাষা, প্রতিমা সমস্ত বৈশিষ্ট্যই স্পষ্ট প্রকাশিত। এ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমেই আধুনিক বাংলা কাব্যাঙ্গনে জীবনানন্দের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হতে থাকে।
প্র : ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের খ্যাতনামা গ্রন্থগুলির অন্যতম। এ কাব্যের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা এবং জীবনানন্দের কবিতাগুলির মধ্যে জনপ্রিয়। ভারতীয় পুরাণের অন্তর্বয়নে যেমন বিদিশা, শ্রাবন্তী উঠে এসেছে, তেমনি বেতের ফলের মতো বা চোখের নীড়ের মতো উপমানগুলো নির্মাণ করেছে নতুন কাব্যমন্ডল। প্রেম ও প্রকৃতি, খন্ড জীবন ও হতাশা, ক্লান্তি ও অবসাদ, ইতিহাসের বিশাল অনুভূতি ও বর্তমানে ছিন্নভিন্ন অস্তিত্ব সমস্ত কিছুর সমাহার এই অপরূপ কাব্যে আলোছায়ার জাল রচনা করেছে। জীবনানন্দের শ্লথগতি ছন্দস্পন্দ, অভিনব শব্দ প্রয়োগ ও অম্বয়, রূপময় ইন্দ্রিয়ালু বাক্যপ্রতিমাগুলি এই কাব্যকে অসামান্য মহিমা দিয়েছে। পাখির নীড়ের মতো চোখ, শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা, অন্ধকারের মতো কালো চুল ইত্যাদি অশ্রুতপূর্ব উপমা প্রয়োগে জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যে এক অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।
প্র : ‘রূপসীবাংলা’ কাব্যগ্রন্থের পরিচয দাও।
উ : ‘রূপসীবাংলা’ ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলি লিখিত হয়েছিল বিশ বছরেরও আগে। প্রথম প্রকাশের সময় ভূমিকায় অশোকানন্দ দাশ জানান যে কবিতাগুলি ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ (১৯৩৬) পর্যায়ের শেষের দিকের ফসল। কবিতাগুলির গঠন সনেটের। এদের বিষয় বাংলার গ্রাম-প্রকৃতি, নদী-নালা, পশু-পাখি, উৎসব, অনুষ্ঠান। জনপ্রিয়তার দিক থেকে আধুনিক বাংলা কবিতা গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘বনলতা সেন’-এর পরেই এর স্থান। ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়’ এ কাব্যের বিখ্যাত পঙ্ক্তি।
প্র : ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি কোন্ কাব্যের অন্তর্গত? প্রকাশকাল কত? কবিতাটির সঙ্গে বিদেশি কোন্ কবির, কোন্ কবিতার মিল আছে?
উ : ‘ধূসর পান্ডুলিপি’, ১৯৩৬। কবি ড.ই ণবধঃং-এর ‘ঞযব ভধষষরহম ড়ভ ঃযব ষবধাবং’ং’ কবিতার মিল আছে।
প্র : জীবনানন্দের মৃত্যুচেতনা কী মৌলিক?
উ : পুরোপুরি মৌলিক নয়, পাশ্চাত্যের কবি রিলকের প্রভাব আছে।
প্র : ‘হায় চিল’ কবিতাটি কোন্ কাব্যের অন্তগর্ত? এর উপর কারো প্রভাব পড়েছে কী?
উ : ‘হায় চিল’ ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যের অন্তর্গত। এই কবিতার সঙ্গে ইয়েটস-এর ‘ঐব ৎবঢ়ৎড়াবং ঃযব পঁৎষড়’ি কবিতার মিল আছে।
প্র : ‘বনলতা সেন’ কবিতার উপর কার প্রভাব আছে?
উ : অ্যাডগার এলেন পো-র ‘টু হেলেন’ কবিতার প্রভাব পড়েছে।
প্র : পাশ্চাত্যের কোন্ কোন্ কবির দ্বারা জীবনানন্দ প্রভাবিত?
উ : ইয়েটস, বোদলেয়ার, অ্যাডগার এলেন পো।
প্র : ‘মাল্যবান’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘মাল্যবান’ (১৯৭৩) উপন্যাস। লেখা হয়েছিল সম্ভবত ১৯৪৮ সালে, প্রকাশিত হয় জীবনানন্দের মৃত্যুর অনেক দিন পরে। বাংলা সাহিত্যের মূল কাহিনি বর্ণনার ধারা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এই উপন্যাসটি। দাম্পত্য জীবনের এক নিষ্ঠুর কাহিনি। সম্পর্কে জটিলতা এবং পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার বোধ এক ইঙ্গিতময় ভাষায় অসামান্য কুশলতার সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে।
প্র : সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া তাঁর আর একটি উপন্যাসের নাম কী?
উ : কল্যাণী (প্রকাশ : দেশ ১৯৯৯)।
প্র : তাঁর মৃত্যু সাল কত?
উ : ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪।
প্র : কীভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন?
উ : ট্রামের নিচে পড়ে আহত হন ও পরে হাসপাতালে মারা যান।