প্র : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম তারিখ কত?
উ : ২৩শে আগস্ট, ১৮৯৮।
প্র : তিনি কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
উ : লাভপুর গ্রাম, বীরভূম।
প্র : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত কী?
উ : তিরিশের দশকের প্রতিনিধি স্থানীয় কথাসাহিত্যিক।
প্র : তাঁর রচিত উপন্যাসগুলোতে কী নিপুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে?
উ : রাঢ় অঞ্চলের গ্রামীণ জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
প্র : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত প্রতিনিধি স্থানীয় উপন্যাসগুলো কী?
উ : চৈতালী ঘূর্ণি (১৯৩১), ধাত্রীদেরবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০), জলসাঘর, কবি (১৯৪২), গণদেবতা (১৯৪২), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৩), হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৪৭), আরগ্য নিকেতন (১৯৫৩), পঞ্চপুন্ডলী (১৯৫৬), রাধা (১৯৫৭) ইত্যাদি।
প্র : ‘হাসুলী বাঁকের উপকথা’র পরিচয় দাও।
উ : ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ (১৯৪৭) উপন্যাসে বীরভূমের কাহার সম্প্রদায়ের জীবন, তাদের সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণ, রূপকথা আন্তরিকতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। একদিকে এই সম্প্রদায়ের আত্মবিরোধ, পরিবর্তন ও বিলুপ্তি যেমন কাহিনির একটি প্রধান ধারা, আর একটি ধারা হল প্রাচীন সমাজের সঙ্গে নতুন পরিবর্তমান জগতের সংঘাত। উজ্জ্বল এর বিচিত্র চরিত্রগুলি। সেই সঙ্গে আছে এক আদিম মানিবিক সংরাগ।
প্র : ‘কালিন্দী’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘কালিন্দী’ (১৯৪০) দুই বিবাদমান জমিদার বাড়ির কাহিনি। নদীর বুকে একটি চরকে কেন্দ্র করে এই দুই পরিবারের দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ সামন্ততান্ত্রিক জীবনের কতগুলি উপাদানের প্রতি তারাশঙ্করের মমতা এবং জমিদার ও শিল্পপতির দ্বন্দ্বে, জমিদারদের পরাজয়ের জন্য বেদনাবোধ উপন্যাসে স্পষ্ট।
প্র : ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘আরোগ্য নিকেতন’ (১৯৫৩) ১৯৫২ সালে শারদীয় আনন্দবাজারে ‘সঞ্জীবন ফার্মাসী’ নামে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই কাহিনির নায়ক এক কবিরাজ, জীবনমশায়্ তার জীবনদর্শনের সঙ্গে নব্যশিক্ষিত ডাক্তার প্রদ্যোতের আদর্শিক সংঘাত উপন্যাসে উল্লেখযোগ্য। একদিকে প্রাচীনবিদ্যা ও নবীন শিক্ষার টানাপোড়েন, অন্যদিকে জীবনমশায়ের মৃত্যুরহস্য জিজ্ঞাসা কাহিনিটিকে প্রগাঢ় করে তুলেছে। তারাশঙ্করের অন্যান্য উপন্যাসের মতো এ উপন্যাসেও রয়েছে প্রাচীন ও আধুনিক ভারতীয় দৃষ্টিতে ও পাশ্চাত্য ভাবনায় সংঘাত, সেই সঙ্গে আছে তাঁর মৃত্যু-জিজ্ঞাসা।
প্র : ‘কবি’ উপন্যাস সম্পর্কে লেখ।
উ : ‘কবি’ (১৯৪১) ডোম সম্প্রদায়ের একজন যুবকের কবি রূপে প্রতিষ্ঠা এবং দুটি নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক বিষয়ক উপন্যাস। আখ্যানের নিপুণ বিন্যাস, চরিত্রগুলির উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং গানের সহজ কথার সঙ্গে জড়িত সংলাপ ও বেদনা সব মিলে এই উপন্যাসটি তারাশঙ্করের একটি শ্রেষ্ঠ রচনা। এই উপন্যাসের ‘জীবন এত ছোট ক্যানে’ সংলাপটি ক্লাসিক মর্যাদা পেয়েছে।
প্র : ‘যতিভঙ্গ’ ভিন্নধর্মী উপন্যাস, কেন?
উ : ‘যতিভঙ্গ’ (১৯৬২) এক অবাঙালি যুবতী রৌশনকে নিয়ে লেখা। বাংলা উপন্যাসে অবাঙালি চরিত্র বিরল। সেদিক থেকে কাহিনিটি উল্লেখযোগ্য। আধুনিক নারীর জীবনজিজ্ঞাসা ও মূল্যবোধ, নগরকেন্দ্রিক জীবনের নানান সমস্যা এই কাহিনিতে দেখা দিয়েছে। তারাশঙ্করের গ্রাম-নির্ভর সাহিত্যসৃষ্টিতে যে-কটি ব্যতিক্রম আছে ‘যদিভঙ্গ’ তার অন্যতম।
প্র : ‘অভিযান’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘অভিযান’ (১৯৪৬) উপন্যাসে মফস্বল অঞ্চলের ট্যাকসি ড্রাইভারদের জীবন উপজীব্য। একদিকে তথ্যনিষ্ঠ তীক্ষè পর্যবেক্ষণ, অন্যদিকে মানুষের আচার-আচরণের বৈচিত্র্য, রূঢ় ও জটিল, কর্কশ ও প্রবল বলিষ্ঠতা এই কাহিনির বৈশিষ্ট্য। সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
প্র : তারাশঙ্করের কোন্ কোন্ উপন্যাসকে আঞ্চলিক উপন্যাস বলা হয়। কেন বলা হয়?
উ : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম, হাঁসুলিবাঁকের উপকথা, নাগিনী কন্যার কাহিনী প্রভৃতি উপন্যাসকে আঞ্চলিক উপন্যাস বলা হয়। কারণ এই সব উপন্যাসের পটভূমি রাঢ় বাংলা, বিশেষ করে বীরভূম অঞ্চলের বৃহৎ মানবগোষ্ঠী ও তাদের সমাজের সামগ্রিক রূপ এতে অঙ্কিত হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সব পরিচয়ই এখানে আছে। যেন প্রতিটি উপন্যাসই একটি অণু-অঞ্চল।
প্র : কত খ্রিষ্টাব্দে কীসের জন্য তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তরীণ হন?
উ : ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আই.এ পাঠকালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের জন্য অন্তরীণ হন।
প্র : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত প্রথম ছোটগল্পের নাম কী? এটি কবে প্রকাশিত হয়?
উ : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত ছোটগল্পের নাম ‘রসকলি’। এটি প্রকাশিত হয় ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে?
প্র : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত প্রথম উপন্যাসের নাম ও এর রচনাকাল কত খ্রিষ্টাব্দে?
উ : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত প্রথম উপন্যাসের নাম ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ রচনাকাল ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী কোন্ এক সময়।
প্র : ‘জলসাঘর’ গল্পগ্রন্থ সম্পর্কে লেখ।
উ : ‘জলসাঘর’ (১৯৩৭) এগারোটি গল্পের সংকলন। প্রত্যেকটি গল্পের পটভূমি গ্রামবাংলার জমিদারের প্রতাপ ও তার অবক্ষয়ের শোচনীয় রূপ। জমিদারতন্ত্রের সমৃদ্ধি ও অবসানের রূপ এই গল্পগুলিতে লক্ষ করা যায়।
প্র : ‘অগ্রদানী’ গল্প সম্পর্কে লেখ।
উ : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর একটি ‘অগ্রদানী’। গরিব পূর্ণ চক্রবর্তী রাজভোগের আশায় কৌশলে নিজপুত্রকে তুলে দেয় শ্যামাদাস জমিদারের হাতে। কিন্তু সেই পুত্রের অকাল মৃত্যু হলে তার শ্রাদ্ধে পিন্ডভক্ষণ কালে লোভী চক্রবর্তী তার ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু নিয়তির শাস্তির হাত থেকে সে রক্ষা পায় না। এরকম কাহিনিতে গল্পটি রচিত হয়েছে। গল্পটিতে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। পরে ‘রসকলি’ গল্পগ্রন্থে ১৯৩৮ সালে স্থান পায়।
প্র : তারাশঙ্করের ত্রয়ী উপন্যাস কোনগুলো?
উ : ধাত্রীদেবতা, গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম।
প্র : ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘ধাত্রী দেবতা’ (১৯৩৯) বঙ্গশ্রী পত্রিকায় (১৯৩৪) ‘জমিদারের মেয়ে’ নামে ছোট আকারে প্রথম প্রকাশিত। চার বছর পরে শনিবারের চিঠিতে ‘ধাত্রী দেবতা’ নামে এই উপন্যাসটি যথাযথভাবে প্রকাশিত হয়। এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশকে কেন্দ্র করে দেশের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের নানা আন্দোলন ও পরিবর্তন এই উপন্যাসের উপজীব্য।
প্র : গণদেবতা-পঞ্চগ্রাম উপন্যাস সম্পর্কে লেখ।
উ : ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), গণদেবতা (১৯৪৩), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪) মূলত একই স্বরে বাঁধা। কারণ শিবনাথ নামক এক ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চরিত্রকে অবলম্বন করে তিনটি উপন্যাসই বিকশিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময় ও সমাজ গণদেবতা পঞ্চগ্রামে মুখ্য। এ সময় ভারতের গ্রামীণ সমাজে ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের সঙ্গে নব্যধনবাদের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। হরিশ মন্ডল, দ্বারকা চৌধুরী, দেবু ঘোষ, ইরসাদ মিঞা, রামভল্লার নানা বৃত্তি, ধর্ম, গোত্র উপন্যাসকে মহাকাব্যোচিত করেছে। এখানে গ্রামীণ উৎসব, রাজনীতি, সংকীর্ণতা, প্রেম, যৌনতা সবই উঠে এসেছে। উপন্যাসে সংস্কারবাদী মন নিয়ে এগিয়ে আসে দেবু ঘোষ, চন্ডীমন্ডপকে নির্ভর করে তার এ অগ্রযাত্রা। ‘পঞ্চগ্রামে’র শেষে ছিরুপাল শ্রীহরি ঘোষ নামগ্রহণ করে সমাজপতি হয়ে ওঠে। তারাশঙ্কর দেখিয়েছেন, আগত নতুন সমাজে ধর্মগুরুরা বিত্তশালীদের কাছে পরাস্ত হবে, এটাই সময়ের দাবি।
প্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে রচিত তাঁর উপন্যাসের নাম কী?
উ : ‘একটি কালো মেয়ের কথা’ (১৯৭১)।
প্র : তাঁর রচিত উপন্যাসগুলোতে কী জীবন্ত রূপে প্রকাশিত হয়েছে?
উ : মানবচরিত্রের নানান জটিলতা ও নিগূঢ় রহস্য।
প্র : তিনি আর কী হিসেবে প্রসিদ্ধ?
উ : গল্পকার হিসেবে।
প্র : তাঁর রচিত ছোটগল্পগুলো কী?
উ : রসকলি, বেদেনী, ডাকহরকরা।
প্র : তাঁর রচিত কোন কোন গল্প ও উপন্যাস অবলম্বনে সার্থক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে?
উ : দুই পুরুষ, কালিন্দী, আরোগ্য নিকেতন, সপ্তপদী ইত্যাদি।
প্র : তিনি কী কী পুরস্কারে ভূষিত হন?
উ : সাহিত্যকৃতির জন্য শরৎ স্মৃতি পুরস্কার, জগত্তারিণী স্মৃতিপদক, রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কার।
প্র : তিনি কী কী উপাধি লাভ করেন?
উ : পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ উপাধি।
প্র : তিনি কোথায় এবং কত তারিখে মৃত্যুবরণ করেন?
উ : কলকাতা; ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।
প্র : তারাশঙ্করের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের ভারতস্থ হাই কমিশনার প্রেরিত শোকবার্তায় কী বলা হয়েছে?
উ : ভারতস্থ বাংলাদেশ (প্রবাসী সরকারের) হাই কমিশনার এম. হোসেন ১৯৭১ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর পি.আর/৪৮/৭১ স্মারকমূলে এই শোকবার্তা প্রেরণ করেন: ‘প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হঠাৎ তিরোধানের সংবাদে শোকাভিভূত হলাম। সাহিত্যজগতের মুকুটমণির এই তিরোধানে তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করতে অনেক সময় লাগবে এবং সাহিত্যকেন্দ্রেও এ ক্ষতি বিরাট। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান ছিল অসীম। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি ও তাঁর আত্মীয়বর্গকে জানাই আমার প্রগাঢ় সমবেদনা।’