উনিশ শতকের আগে পর্যন্তবাংলা বানানের নিয়ম বলতে বিশেষ কিছু ছিল না। উনিশ শতকের সূচনায় যখন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক পর্ব শুরু হল, বাংলা সাহিত্যিক গদ্যের উন্মেষ হল, তখন মোটামুটি সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসন অনুযায়ী বাংলা বানান নির্ধারিত হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় বহু তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ থাকলেও অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশী, বিদেশী শব্দের পরিমাণ কম নয়। এছাড়া রয়েছে তৎসম অ-তৎসম প্রত্যয়, বিভক্তি, উপসর্গ ইত্যাদি সহযোগে গঠিত নানারকমের মিশ্র শব্দ। তার ফলে বানান নির্ধারিত হলেও বাংলা বানানের সমতাবিধান সম্ভবপর হয় নি। তাছাড়া, বাংলা ভাষা ক্রমাগত সাধু রীতির নির্মোক ত্যাগ করে চলিত রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। তার উপর, অন্য অনেক ভাষার মত বাংলারও লেখ্য রূপ সম্পূর্ণ ধ্বনিভিত্তিক নয়। তাই বাংলা বানানের অসুবিধাগুলো চলতেই থাকে। এই অসুবিধা ও অসঙ্গতি দূর করার জন্য প্রথমে বিশ শতকের বিশের দশকে বিশ্বভারতী এবং পরে ত্রিশের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম নির্ধারণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রসহ অধিকাংশ পন্ডিত ও লেখক সমর্থন করেন। এখন পর্যন্ত এই নিয়মই আদর্শ নিয়মরূপে মোটামুটি অনুসৃত হচ্ছে।
তবু বাংলা বানানের সম্পূর্ণ সমতা বা অভিন্নতা যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নয়। বরং কালে কালে বানানের বিশৃঙ্খলা যেন বেড়ে গেছে। কতকগুলো শব্দের ক্ষেত্রে দেখা যায় নানাজনে নানারকম বানান লিখছেন। বাংলার মত উন্নত ভাষার পক্ষে এটি গৌরবের কথা নয়। বানানের এইসব বিভিন্নতা ও বিশৃঙ্খলার কী কী ভাষাতাত্ত্বিক, ধ্বনিতাত্ত্বিক, এমনকি সামাজিক কারণ থাকতে পারে এখানে সে আলোচনার দরকার নেই। তবে অনেক চলমান ও বর্ধিষ্ণু ভাষাতেই দীর্ঘকাল জুড়ে ধীরে ধীরে বানানের কিছু কিছু পরিবর্তন হতে দেখা যায়। তখন এক সময়ে বানানের নিয়ম নতুন করে বেঁধে দেওয়ার বা সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়। পূর্বে বলেছি, এ যাবৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দেশিত নিয়ম আমরা অনুসরণ করে চলেছি। কিন্তু আধুনিক কালের দাবি অনুযায়ী, নানা বানানের যেসব বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তিআমরা দেখছি সেই পরিপ্রেক্ষিতে বানানের নিয়মগুলোকে আর একবার সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিশেষত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দেশিত নিয়মে বিকল্প ছিল কিছু বেশি। বিকল্প হয়তো একেবারে পরিহার করা যাবে না কিন্তু যথাসাধ্য তা কমিয়ে আনা দরকার। এইসব কারণে বাংলা একাডেমী বাংলা বানানের বর্তমান নিয়ম নির্ধারণ করছে।