Tuesday, October 8, 2024

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্র : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম তারিখ কত?
উ : ২৬শে জুন, ১৮৩৮ (১৩ই আষাঢ়, ১২৪৫)।
প্র : তিনি কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
উ : কাঁঠালপাড়া গ্রাম, চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ।
প্র : তিনি মূলত কী ছিলেন?
উ : ঔপন্যাসিক ও বাঙালির নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত।
প্র : তিনি প্রথম কোন পত্রিকায় কবিতা লিখে সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন?
উ : সম্বাদ প্রভাকরে।
প্র : তাঁর রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম কী?
উ : ললিতা তথা মানস (১৮৫৬)।
প্র : তাঁর রচিত প্রথম বাংলা উপন্যাসের নাম কী?
উ : দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫)। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস।
প্র : তাঁর রচিত দ্বিতীয উপন্যাসের নাম কী?
উ : কপালকুন্ডলা (১৮৬৬)।
প্র : ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’।-এই সংলাপ সম্পর্কে কী বলা হয়?
উ : কপালকুন্ডলার এই সংলাপকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোম্যান্টিক সংলাপ।
প্র : এই উপন্যাসের আর একটি উ্েলখযোগ্য বাক্য কি?
উ : ‘তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?’
প্র : দ্বাদশ শতাব্দীর বঙ্গদেশের রাজনৈতিক পটভূমিকায় তাঁর রচিত উপনাসের নাম কি?
উ : মৃণালিনী (১৮৬৯)।
প্র : সামাজিক সমস্যার আলোকে তাঁর রচিত উপন্যাসগেুলোর নাম কী?
উ : বিষবৃক্ষ (১৮৭৩), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮)।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ মূলক উপন্যাস কোনটি?
উ : রজনী (১৮৭৭)।
প্র : তাঁর রচিত কোন উপন্যাসে হিন্দুর বাহুবল ও বীরত্ব রূপায়িত হয়েছে?
উ : রাজসিংহ (১৮৮২), আনন্দমঠ (১৮৮২)।
প্র : তাঁর রচিত নিষ্কাম ধর্মের ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয় কোন উপন্যাসে?
উ : দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪), সীতারাম (১৮৮৭)।
প্র : বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয় কাকে?
উ : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা উপন্যাসকে জনক বলা হয় কেন?
উ : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা উপন্যাসকে জনক বলার কারণ হলো, বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম পান্ডাত্যরীতি অবলম্বন করে একটি পরিপূর্ণ আখ্যান রচনা করেন। উপন্যাস একটি পান্ডাত্য শিল্প-ধারণা। এখানে একটি ক. প্লট থাকবে; খ. আখ্যানবস্তুর দেশকালগত অবস্থান ও পরিবর্তন দেকা যাবে; গ. চরিত্রের গঠন ও বিবর্তন, পরিণতি ও পরিব্যক্তি থাকবে; ঘ. সময় ও স্থানের ঐক্য থাকবে। এই বিচারে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের আগে কেউ সর্বাঙ্গ সার্থক উপন্যাস লিখতে পারেন নি। ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ ও ‘আলারের ঘরের দুলাল’ উপন্যাস-যাচাইয়ের মাপকাঠিতে সর্বাঙ্গ সার্থক নয়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫) রচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনার স্বাক্ষর রাখেন। এরপর তিনি সে ধারাকে বেগবান করেন এবং একের পর এক সার্থক উপন্যাস রচনা করে চলেন বলে বঙ্কিমচন্দ্রকে বাংরা উপন্যাসের জনক বলা হয়।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের ত্রয়ী উপন্যাস বলে কোনগুলোকে?
উ : আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪), সতিারাম (১৮৮৭)।
প্র : ‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাস সম্পর্কে লেখ।
উ : ‘কপালকুন্ডলা’ (১৮৬৬) বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় উপন্যাস। এতে নিগূঢ় ভাবসঙ্গতির জন্য ‘রোমান্স’ বলা যায়। অরণ্যে এক কাপালিক-পালিতা নারী কপালকুন্ডলাকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে। সামাজিক সংস্কারের সঙ্গে অপরিচিতা এই নারীর নবকুমারের সঙ্গে বিয়ে এবং কপালকুন্ডলার সমাজবন্ধনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এই কাহিনির মূল ঘটনা। কুপালকুণডলার মধ্যে যে রহস্য সেই রহস্য উদঘাটনই উপন্যাসের প্রধান বিষয়। কাহিনিতে একদিকে আছে সম্রাট জাহাঙ্গিরের সময়কার আগ্রার নগর ও স্থাপত্য এবং অন্যদিকে অরণ্য ও সমুদ্র। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও রহস্যময়তা, কপালকুন্ডলার চরিত্র, কাহিনির ট্র্যাজিক পরিণতি এই তিনটি কারণে উপন্যাসটি বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম স্মরণীয় রচনা। বঙ্কিমের জীবৎকালেই এই উপন্যাসের আটটি সংস্করণ হয়। অনেকের মতে এটি বঙ্কিমের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র : কুপালকুন্ডলা, নবকুমার, কাপালিক ইত্যাদি। গিরিশচন্দ্র ঘোষ এই উপন্যাসের একটি নাট্যরূপ দেন (১৮৭৩) এবং দামোদর মুখোপাধ্যায় এই উপন্রাসের একটি উপসংহার উপন্যাস রচনা করেন এবং নামকরণ করেন ‘মৃন্ময়ী’ (১৮৭৪)।
প্র : ‘মৃণালিনী’ উপন্যাস সম্পর্কে লেখ।
উ : ‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯) ত্রয়োদশ শতাব্দীর বাংলাদেশ ও তুর্কি আক্রমণ এর ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচিত। মগধের রাজপুত্র হেমচন্দ্রের সঙ্গে মৃণালিনীর প্রণয় এবং দেশরক্ষার জন্য হেমচন্দ্রের সংকল্প ও ব্যর্থতার সঙ্গে এক রহস্যময়ী নারী মনোরমার কাহিনি এ উপন্যাসের মূল কথাবস্তু। বঙ্কিমের দেশাত্মবোধ এবং ইতিহাস জিজ্ঞাসার প্রথম প্রকাশ এই উপন্যাসে। ঐতিহাসিক ঘটনার অন্তরালে হেমচন্দ্র-র্মণালিনী এই পশুপতি-মনোরমার প্রেমকাহিনি এই উপন্যাসে প্রধান হয়ে উঠেছে। ইতিহাসের উপনাদান নিয়ে এখানে জীবনকে মুখ্য করা হয়েছে।
প্র : ‘বিষবৃক্ষ’ শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কেন?
উ : ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত সামাজিক উপন্যাস। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় সমস্যার সঙ্গে বিধবা বিবাহ, পুরুষের একাধিক বিবাহ তার রূপতৃষ্ণা ও নৈতিকতার দ্বন্দ্ব, নারীর আত্মসম্মান ও অধিকারবোধ প্রভৃতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বাংলা উপন্যাসে বিষবৃক্ষের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। চরিত্রায়নে ঘটনা সংস্থানে এবং জীবনের কঠিন সমস্যার রূপায়ণে ‘বিষবৃক্ষ’ বাংলা সাহিত্যের অন্রতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। কারণ বঙ্কিমচন্দ্রের আগে আর কোন লেখক এ জাতীয় বিষয় নিয়ে উপন্যাস রচনার চেষ্টা পর্যন্ত করেন নি। বাল্যবিধবা কুন্দনন্দিনী প্রেম ও কামনার বিকাশকে তৎকালনি সমাজ যে প্রশয় দেয় নি, এ উপন্যাস তার প্রমাণ। লেখকও মনে করেছেন, কুন্দর কাহিনি পাঠ করার ফলে ঘরে ঘরে অমৃত ফলবে অর্থাৎ এ ধরনের প্রণয়াকাক্সক্ষা রহিত হবে। বঙ্কিমচন্দ্র কী চেয়েছেন সেটি মুখ্য নয়। ‘বিষবৃক্ষে’ তিনি সমস্যার যে যথার্থ রূপায়ণ করতে পেরেছেন এটাই আসল। ‘বিষবৃক্ষ’ আজও বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর একটি।
প্র : ‘ইন্দিরা’ গল্প না উপন্যাস?
উ : ‘ইন্দিরা’ (১৮৭৩) ছোট উপন্যাস (নভেলা), অনেকে বলেন বড়ো গল্প। ১৮৭২ সালে ‘বঙ্গদর্শনে’ প্রথম প্রকাশিত এবং ‘উপকথা’ (১৮৭৭) গ্রন্তে সংকলিত। ১৮৯৩ সালে পুনর্লিখিত এবং পরিবর্ধিত হয়। এই কাহিনিটি উত্তমপুরুষের বয়ানে রচিত। কৌতুক-পরিহাসপূর্ণ উপভোগ্য কাহিনি ‘ইন্দিরা’। অনেকের মতে, বঙ্কিমচন্দ্রের কালে শিল্পমাধ্যম হিসেবে ছোটগল্পের অস্তিত্ব ছিলো না বলে তিনি একটি গল্পের বিষয়কে উপন্যাসে রূপ দিতে গিয়েছেন। তাঁদের মতে, ‘ইন্দিরা’ বাংলা ছোটগল্পের ইঙ্গিত, সূচনার বার্তাবহ।
প্র : ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ সম্পর্কে লেখ।
উ : ‘যুগলাঙ্গরীয়’ (১৮৭৪) ছোট আখ্যান। কেউ বলে থাকেন নভেলা বা ছোট উপন্যাস, কেউ বলেন বড় গল্প। বঙ্কিম একে বলেছেন উপকথা। প্রাচীন পটভূমিকায় একটি প্রেম কাহিনি। পটভূমিকায় একটি প্রেম কাহিনি। ছোটগল্প শিল্পমাধ্যমটি ওইকালে থাকলে ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ একটি গল্প হতে পারত। ‘ইন্দিরা’র পর এই আখ্রানে বঙ্কিমচন্দ্র আবার একই ফর্মচর্চা করেন।
প্র : ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাস সম্পর্কে লেখ।
উ : ‘চন্দ্রশেকর’ (১৮৭৫) প্রথমে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। প্রতাপ ও শৈবলিনীর বাল্যপ্রণয় এবং সেই প্রেমের করুণ পরিণতি এই উপন্যাসের প্রধান কাহিনি। প্রেম, দাম্পত্য আদর্শ, সমাজের শাসন, সতীত্ব ইত্যাদি এই কাহিনিতে বিশেষভাবে সমস্যায়িত হয়েছে। এই উপন্যাসের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ বঙ্কিমের নীতি ও প্রথানুগত্য। কেননা, লেখক এখানে ‘তবে যাও প্রতাপ, স্বর্গধামে’ বলে নায়ককে পরলোকের পথ দেখিয়েছেন। উপন্যাসটির পটভূমি ইংরেজ শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং মির কাসিমের সঙ্গে ইংরেজদের সংগ্রাম। ইতিহাসাশ্রয়ী ঘটনা রসঙ্গে গার্হস্থ্য জীবনের কাহিনির রূপায়ণ ঘটেছে বলে মির কাসিম-দলনি বেগমের সঙ্গে চন্দ্রশেখর-প্রতাপ-শৈবলিনীর আখ্যান রচিত হয়েছে এই উপন্যাসে।
প্র : ‘রজনী’ কী প্রকৃত উপন্যাস?
উ : ‘রজনী’ (১৮৭৭) উপন্যাসের নায়িকা রজনীর সঙ্গে লর্ড লিটন প্রণীত ‘দি লাস্ট ডেজ অফ পম্পেই’ নামক উপন্যাসের নিডিয়া চরিত্রের কিছুটা ঐক্য আছে। বিভিন্ন পাত্র-পাত্রীর জবানবন্দিতে এই উপন্যাস রচিত। এই রীতিটিও যে বঙ্কিম ইংরেজ ঔপন্যাসিক কার্লিনস অনুসরণে করেছেন তা তিনি ভূমিকায় জানিয়েছেন। বাংলা উপন্যাস গড়ে তুলবার জন্য এভাবেই পান্ডাত্যের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমের অধিকাংশ উপন্যাসের মতোই এখানেও প্রেম ও আদর্শের সংঘাতই কাহিনির মূল উপজীব্য। ‘রজনী’কে প্রকৃত উপন্যাস না বলে রোমান্স বলা হয়ে থাকে। কারণ এখানে বেশ কল্পদৃশ্যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
প্র : ‘কৃষ্ণকাস্তের উইল’ কী?
উ : ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮) বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং সমকালে বিতর্কিত উপন্যাস। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিষবা নারী রোহিনীকে অবলম্বন করে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই শিল্পবোধ ও নৈতিক আদর্শের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ঔপন্যাসিকের জীবদ্দশায় এই গ্রন্থের চারটি সংস্করণ হয়। প্রধান চরিত্র : রোহিনী, গােবিন্দলার, ভ্রমর।
প্র : ‘সীতারাম’ উপন্যাস সম্পর্কে লেখ।
উ : ‘সীতারাম’ (১৮৮৭) বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বশেষ উপন্যাস। সীতারাম একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। উপন্যাসে ঐতিহাসিক কিছু ঘটনাও আছে। মূলত এটি এক ব্যক্তির পারিবারিক জীবনের এবং আদর্শের ট্র্যাজেডি। বঙ্কিমের ধর্মচিন্তা এই উপন্যাসের গঠনকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। তবে চরিত্রসৃষ্টির নৈপুণ্য এবং কাহিনির বর্ণনা কুশলতায় বঙ্কিমের প্রতিভার ছাপ স্পষ্ট। তাঁর ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরাণী’ ও ‘সীতারাম’কে ‘ত্রয়ী’ উপন্যাস বলা হয।
প্র : ‘আনন্দমঠ’ গ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিকায় সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ছায়া অবলম্বনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে ১৮৮২ সালে। উপন্যাসটিতে প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে স্বদেশভক্তি, স্বজাতি ও স্বধর্মপ্রীতি। এই উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র স্বদেশ বলতে বঙ্গভূমিকে, আর ধর্ম বলতে হিন্দু ধর্মকে বুঝিয়েছেন। বন্দে আতরম্ গান দ্বারা বুঝিয়েছেন ইংরেজ বিরোধী আন্দেলনের দীক্ষা। উল্লেখ্য যে এটি কোন ঐতিহসিক উপন্যাস নয়্ এর ঘটনা কল্পিত কিন্তু অবিশ্বাস্য নয়। চরিত্রগুলি আদর্শায়িত। মন্বন্তরের বর্ণনা নিখুঁত, সাধারণ গ্রামীণ জীবনের আখ্যান বাস্তব। সর্বোপরি প্রেম এবং আদর্শের দ্বন্দ্ব এই উপন্যাসের কাহিনিকে নিবিড়তা দিয়েছে। কিন্তু এই উপমহাদেশের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে এ উপন্যাসের মূল্য াসামান্য। বঙ্কিমচন্দ্র রচিত এই গ্রন্থের ‘বন্দে মাতরম্’ গানটির ভূমিকা যেমন ঐতিহাসিক, তেমনি ঐতিহাসিক এই উপন্যাসের প্রভাব। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত The Abbey of Bliss (1907) এবং শ্রী অরবিন্দ Ananda Math (1910) নামে উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। এটি মূলত বাস্তবানুগ রোমান্সধর্মী উপন্যাস। এই গ্রন্থের রচিত গানের ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি পরবর্তীকালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারীদের অত্যন্ত প্রিয় ও উদ্দীপক স্লোগান হিসেবে গৃহীত হয়। এই গ্রন্থ থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় স্বসম্প্রদায়প্রীতি লক্ষ করা যায়।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিবিধ প্রবন্ধে’র পরিচয় দাও।
উ : ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১ম খন্ড ১৮৮৭, ২য় খন্ড ১৮৯২) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত প্রবন্ধাবলি। প্রথম খন্ডের বিষয়বস্তু মূলত সাহিত্যকেন্দ্রিক। বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের ইতিহাসে এই প্রবন্ধগুলির ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। দ্বিতীয় খন্ডে ধর্ম, সমাজ, ইতিহাস বিষয়ে অনেকগুলি প্রবন্ধ আছে। এই প্রবন্ধগুরোতেও বঙ্কিমচন্দ্র প্রবন্ধ রচনার নির্দিষ্ট পথে বাংলা প্রবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ পথ সূচনা করেলেন। ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১৮৯৫) নামে ভূদেব মুখোপাধ্যায়েরও একটি প্রবন্ধ সংকলন আছে।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের কোন গ্রন্থে গদ্যকবিতার বৈশিষ্ট্য আছে বলে মনে করা হয়?
উ : ‘গদ্যপদ্য বা কবিতাপুস্তক’ (১৮৯১)। ১৭৭৮-এ প্রকাশিত ‘কবিতাপুস্তক’ নামক পদ্যসঙগ্রহের সঙ্গে কয়েকটি গদ্যরচনা যুক্ত করে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। অনেকের মতে এই গ্রন্থের কোনো কোনো গদ্যরচনায় গদ্য কবিতার পূর্বাবাস লক্ষ করা যায়। সে বিবেচনায় এই গ্রন্থটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
প্র : ‘সাম্য’ গ্রন্থটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উ : ‘সাম্য’ (১৮৭৯) গদ্যগ্রন্থ। ‘বঙ্গদর্শনে’ প্রকাশিত ‘সাম্য’ বিষয়ক তিনটি এবং ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধের কিছু অংশ নিয়ে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ইউরোপীয় সাম্যবচিন্তার ধারার ইতিহাস এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজ ও অর্থনৈতিক প্রগতিশীল চিন্তা প্রকাশিত। তবে পরবর্তী জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র ‘সাম্য’ গ্রন্থটি পুনর্মুদ্রণ করেন নি। বঙ্কিমচন্দ্রের আগে বাংলা ভাষায় সাম্যবাদী চিন্তার এ ধরনের গ্রন্থ প্রকাশ হতে দেখা যায় না। এই ঐতিহাসিক কারণেও ‘সাম্য’ গ্রন্থটি গুরুত্বপূণ্ ৃএই গ্রস্থভুক্ত প্রবন্ধগুলোতে সমাজে সাম্যপ্রতিষ্ঠা কামনা এবং কৃষকদের দুঃখের কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক শোষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্র : ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ কোন ধরনের গ্রন্থ?
উ : ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ (১৮৭৫) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বিভিন্ন মেজাজের লঘু ঢঙে লেখা ব্যক্তিগত প্রবন্ধ। কমলাকান্ত নামক এক চরিত্রের জবানিতে প্রবন্ধগুলি লিখিত। ফলে এদের মধ্যে একটি ক্ষীণ আখ্যানগত এবং চরিত্রগত ঐক্য আছে। কমলাকান্ত নামক আফিমখোর, খ্যাপাটে কিন্তু চিন্তাশীল ও কবিপ্রতিভাসম্পন্ন চরিত্রটি বঙ্কিমের অনন্য সৃষ্টি। মনে করা হয়, কমলাকান্ত বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই। কমলাকান্ত আফিম খেলেই বিদ্যদৃষ্টি ফিরে পায়। তার কবিত্ব, দেশপ্রেম, দার্শনিকতা, ব্যঙ্গ ও বিদ্রƒপশক্তি সমস্তই একাধারে এই গ্রন্থে ঘনীভূত। প্রসন্ন গোয়ালিনী কমলাকান্তের অনুষঙ্গী চরিত্র। বঙ্কিমচন্দ্র যে কত মহৎ গদ্যশিল্পী এ গ্রন্থে তা বোঝা যায়। তৎসম শব্দের স্থাপত্যধর্মী স্বভাব পরিত্যাগ করে কএ গ্রন্থে তিনি পেলব গদ্যশৈলী নির্মাণ করেছেন্ অনেকের মতে, কমলাকান্তের দ প্তর বঙ্কিমচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম রচিত উপন্যাসের নাম কী?
উ : রাজমোহনস ওয়াইফ্ ইংরেজিতে লেখা। প্রকাশ : ১৯৩৫।
প্র : তিনি কী হিসেবে খ্যাত?
উ : প্রাচ্য ও পান্ডাত্য ভাবাদর্শের সমস্বয় সাধনকারী হিসেবে।
প্র : তিনি বাংলা ভাষার সমালোচনায় কোন ধারার প্রথ প্রদর্শক?
উ : তুলনামূলক সমালোচনা ধারার।
প্র : তিনি কী কী বিষয়ের উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ রচনা করেছেন?
উ : ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, ভাষা, সমাজ ইত্যাদি।
প্র : তাঁর রচিত প্রবন্ধগুলোর নাম কী?
উ : লোকরহস্য (১৮৭৪), কমলাকান্তের দপ্তর (১৮৭৫), বিবিধ সমালোচনা (১৮৭৬), ধর্মতত্ত্ব অনুশীলন (১৮৮৮) ইত্যাদি।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর কোন গ্রন্থটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেন?
উ : সাম্য (১৮৭৯)।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের ছদ্মনাম কী?
উ : কমলাকান্ত।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম কীর্তি কী?
উ : বঙ্গদর্শন (১৮৭২) পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রকে বাদ দিয়ে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার চারজন বিশিষ্ট লেখকের নাম লেখ।
উ : বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রথম প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ভাবধারার মিলন ঘটিয়েছিলেন। তিনি ছাড়া এই পত্রিকার বিশিষ্ট চারজন লেখক হলেন-সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
প্র : বাংলা ভাষায় ভ্রমণ সাহিত্যের প্রথম রচয়িতা কে? ভ্রমণ কাহিনিটির নাম কি?
উ : বাংলা ভাষায় ভ্রমণ সাহিত্যের প্রথম রচয়িতা বঙ্কিমভ্রাতা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ‘পালামৌ’ (১৮৮০)। ছোটোনাগপুরের বিশেষ অঞ্চরের ভ্রমণকাহিনি।
প্র : ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কে ছিলেন? পত্রিকাটি কত সালে প্রকাশিত হয়?
উ : ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পত্রিকাটি ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের পরে কে বঙ্গদর্শন সম্পাদনা করেছিলেন?
উ : বঙ্কিমচন্দ্রের পরে বঙ্গদর্শন সম্পাদনা করেছিলেন তাঁর অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্র কোন্ কোন্ ইউরোপীয় দার্শনিকের মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
উ : বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম জীবনে ইউরোপীয় দার্শনিক কোঁতের চিন্তাধারার সমর্থক ছিলেন। এছাড়াও রুশো, বেন্থাম ও মিলের সামাজিক মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
প্র : কমলাকান্তের দপ্তর কোন্ বিদেশি লেখকের কোন্ গ্রন্থের দ্বারা অনুপ্রাণিত।
উ : বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তর ইংরেজ সাহিত্য ও সমালোচক ডি-কুইনসির confession of on English Opium Eater-এর প্রেরণায় রচিত।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ রচনার মূলে কী উদ্দেশ্য ছিল?
উ : বঙ্কিমচন্দ্র জ্ঞান, বিজ্ঞান ও বিবিধ বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করে বাঙালি জাতিকে চিন্তা ও মননশীলতায় দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা ও স্বদেশিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসু ও সচেতন করাও তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের চারটি ইতিহাস আশ্রয়ী রোমান্সধর্মী উপন্যাসের নাম লেখ।
উ : দুর্গেশনন্দিনী কপালকুন্ডলা, চন্দ্রশেখর ও রাজসিংহ।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের খাঁটি ঐতিহাসিক উপন্যাস কোনটি?
উ : বঙ্কিমচন্দ্রের খাঁটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রাজসিংহ।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের দুটি তত্ত্বমূলক উপন্যাসের নাম লেখ।
উ : বঙ্কিমচন্দ্রের দুটি তত্ত্বমূলক উপন্যাস : আনন্দমঠ ও দেবীচৌধুরাণী।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের দুটি সামাজিক উপন্যাসের নাম লেখ।
উ : বঙ্কিমচন্দ্রের দুটি সামাজিক উপন্যাসের নাম বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩) ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮)।
প্র : বঙ্কিমচন্দ্রের রজনী উপন্যাসটি কোন্ ইংরেজি উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে রচিত?
উ : কঙ্কিমচন্দ্রের রজনী উপন্যাসটি ইংরেজ ঔপন্যাসিক লিটন রচিত The last Days of Pompeii অবলম্বনে রচিত।
প্র : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথম গ্রাজুয়েট কে?
উ : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
প্র : বাংলা উপন্যাস রচনায় তাঁর প্রধান কৃতিত্ব কী?
উ : শিল্পসম্মত সার্থক উপন্যাস।
প্র : তিনি সাহিত্যের রসবোদ্ধাদের কাছ থেকে কী আখ্যা লাভ করেন?
উ : সাহিত্যসম্রাট।
প্র : তিনি হিন্দু ধর্মনুরাগীদের কাছ থেকে কী আখ্যা লাভ করেন?
উ : ঋষি।
প্র : তিনি কত তারিখে মৃত্যুবরণ করেন?
উ : ৮ই এপ্রিল, ১৮৯৪ (২৬শে চৈত্র, ১৩০০) রবিবার।

Related Articles

Latest Articles