বাংলা বানান নিয়ে বাঙালি জাতি এক বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পৌঁছেছে। আজ পর্যন্ত এই বিষয়ে অসংখ্য মতামত প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পন্ডিতবর্গ, বিদগ্ধজন বানান নিয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলা একাডেমী প্রমিত বানান অভিধান সংকলন করেছেন। তবু বাংলা বানান নিয়ে সংকটের অবসান হয়নি। একেকজন একেকরকম বানান লিখছেন। প্রমিত বানান সবাই মানছেন না। তাদেরও যুক্তি রয়েছে। বাংলা একাডেমীর সব সুপারিশ যে সঠিক এমন দাবিও তারা করতে পারেন না। তবু, দীর্ঘদিন থেকে বাংলা বানান নিয়ে যে কার্যক্রম চলে এসেছে, তার একটা ইতিহাস জানা থাকলে সাধারণ পাঠকের বানান সম্পর্কে সামগ্রিক সচেতনতা বাড়ে। অন্তত বানান নিয়ে বড় ধরনের সংকটে তাকে পড়তে হয় না এবং তিনি নিজে ভিন্ন প্রকার বানান লিখে থাকলেও তার কার্যকারণ সম্পর্কে একটা নিজস্ব ব্যাখ্যা তিনি দাঁড় করাতে পারবেন। অর্থাৎ বানান সচেতনতা বাড়বে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ থেকে আজকের অনেক পন্ডিত ব্যক্তি বাংলা বানান নিয়ে নানা কথা বলেছেন, সুপারিশ করেছেন। সমস্যার গভীরে যাবার চেষ্টা করেছেন অনেকে। রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত ভাষার ছাঁচে ঢালাই করলেন-সেটা হল অত্যন্ত আড়ষ্ট। বিশুদ্ধভাবে সমস্ত তার বাঁধাবাঁধি-সেই বাঁধন তার নিজের নিয়মসংগত নয়-তার ষত্ব ণত্ব সমস্তই সংস্কৃত ভাষার ফরমাসে। সে হঠাৎ বাবুর মত প্রাণপণে চেষ্টা করে নিজেকে বনেদী বংশের লোক প্রমাণ করত। যারা এই কাজ করে তারা অনেক সময়ই প্রহসন অভিনয় করতে বাধ্য হয়। কর্নেলে গভর্নরে পণ্ডিতি করে মূর্ধন্য-ণ লাগায়, সোনা পান চুনে তো কথাই নেই, বোঝা যায় বাংলা ভাষার বর্ণমালা ও শব্দ সংস্কৃত থেকে ধার নেবার ফলে সংস্কৃতের নিয়ম বাংলা ভাষায় ভর করেছে। অর্থাৎ বানান বিভ্রাটের অন্যতম সমস্যা সংস্কৃত ভাষার অনুসরণ। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ সম্পর্কে বলেছিলেন, বর্ণগুলি আর কিছুই নয়, ভাষায় যে সকল ধ্বনি আছে, তাহার জ্ঞাপক চিহ্ন ছাড়া। এক ভাষার বর্ণমালা অন্যভাষায় ব্যবহার করলে সাধারণত দেখা যায় যে কয়েকটি বর্ণ এই দ্বিতীয় ভাষায় অনাবশ্যক, যেহেতু তাহাতে এই বর্ণগুলি দ্বারা সূচিত ধ্বনির অভাব। অন্য পক্ষে আবার তাহার কয়েকটি বিশেষ ধ্বনির জন্য বর্ণের অভাব লক্ষিত হয়। কাজেই কখন কখন শব্দের বানান শব্দের ধ্বনিগত হয় না। ইহাতে বানান বিভ্রাট আসিয়া উপস্থিত হয়।
১৯২০-এর দশকে বিশ্বভারতী চলতি ভাষার বানানের একটি নিয়ম তৈরি করে। নিয়মটি নির্ধারণ করে দেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং রিভিউ করে দেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের উদ্যোগে ও রবীন্দ্রনাথের অনুমতিক্রমে বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলিতে এই বানান অনুসৃত হতে থাকে। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ১৯২৬ সালে নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যায় এই নিয়মটি ছাপা হয়। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে কয়েকজন পন্ডিত ব্যক্তিকে নিয়ে ১৯৩৫ সালে ‘কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কার কমিটি’ গঠিত হয়। ১৯৩৬ সালের ৮ মে বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম প্রকাশ করেন। ১৯৩৭ সালের মে মাসে নিয়মের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
পাকিস্তান শাসনামল থেকে বাংলাদেশে বাংলা বানান নিয়ে কাজ হলেও কার্যত তা নানা জটিলতায় আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৬৭ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ব্যক্তিগত আগ্রহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা পরিষদ বাংলা ভাষা, ব্যাকরণ ও বর্ণমালা সংস্কার ও সংলায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সদস্যরা যে সুপারিশ প্রস্তাব করেন তা ছিল উদ্ভট। বলা বাহুল্য তা কেউ মানেন নি। ১৯৮৫ সালে পশ্চিম বাংলা আকাদেমি ‘বাংলা বানান সংস্কার-একটি ভিত্তিপত্র’ প্রকাশ করে। আনন্দ পাবলিশার্স নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন’ নামে গ্রন্থ প্রকাশ করে। তারা এই নিয়ম তাদের গ্রুপের জন্য ব্যবহার করে।
বাংলা বানানের সমতা বিধানের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কুমিল্লায় (২১-২৩ অক্টোবর, ১৯৮৮) একটি কর্মশিবিরের আয়োজন করে। ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমী অভিন্ন ও প্রমিত বানানের নিয়ম প্রকাশ করে। কুমিল্লার কর্মশিবিরের সিদ্ধান্তের আলোকে ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ড. আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় ‘পাঠ্যবইয়ের বানান’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বানান বিষয়ক নীতিমালা বাংলাদেশে বানান বিষয়ক নীতিমালায় অনুসৃত হয়েছে। বাংলা একাডেমীর বানান বিষয়ক কমিটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দাবি অনুযায়ী নতুন কিছু নিয়ম সংযোজন করে ‘প্রমিত বাংলা বানান’ এর নিয়মাবলি তৈরি করেছেন। বাংলা একাডেমী এই বানান অনুসরণ করে। বাংলা একাডেমী পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করেন। কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রফেসর আনিসুজ্জামান, অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন প্রফেসর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, জামিল চৌধুরী, নরেন বিশ্বাস এবং বশীর আল হেলাল।