প্র : মীর মশাররফ হোসেন কোথায়, কবে জন্মগ্রহণ করেন?
উ : কুষ্টিয়া জেলার লাহিনীপাড়া গ্রামে; ১৩ই নভেম্বর ১৮৪৭।
প্র : তাঁর পরিচয় কী?
উ : তিনি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও গদ্য রচয়িতা।
প্র : তিনি কোন দুটি পত্রিকায় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন?
উ : কলকাতার সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১) এবং কুমারখালির গ্রামবার্তা প্রকাশিত (১৮৬৩)।
প্র : তাঁর সাহিত্যগুরু কে?
উ : কাঙাল হরিনাথ।
প্র : মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পত্রিকা দুটো কী?
উ : আজীজননেহার (১৮৭৪) ও হিতকরী (১৮৯০)।
প্র : মশারফ হোসেনের প্রথম গ্রন্থ কী পেলেন?
উ : তিনি মুসলিমদের মধ্যে প্রথম গদ্যগ্রন্থ রচয়িতার মর্যাদা পেলেন।
প্র : ‘রতœবতী’ গ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : মীর মশাররফ হোসেন রচিত প্রথম গ্রন্থ। এটি কোন মুসলিম রচিত প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে মূল্রবান। এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২রা সেপ্টেম্বর ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে, কলিকাতা থেকে। লেখক নাম-পৃষ্ঠায় গ্রন্থটিকে ‘কৌতুকাবহ উপন্যাস’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এটি রূপকথা জাতীয় শিক্ষামূলক একটি দীর্ঘ গল্প। রাজপুত্র সুকুমার ও মন্ত্রীপুত্র সুমন্তের মধ্যে ‘ধন বড় না বিদ্যা বড়’-এ বিতর্ক এবং বিতর্কের সমাধানই ‘রতœবতী’র মূল এবং বিতর্কের সমাধানই ‘রতœবতী’র মূল বিষয়।
প্র : মশাররফ হোসেন রচিত একমাত্র প্রহসন সম্পর্কে লেখ।
উ : ‘এর উপায় কি?’ মীর মশাররফ হোসেন রচিত একমাত্র প্রহসন। উনিশ শতকে এক শ্রেণির লোক যে স্ত্রীর প্রতি অবহেলা দেখিয়ে মদ ও পতিতাবৃত্তিতে আকৃষ্ট হয়ে নানা ধরনের অনাচার ও উচ্ছৃঙ্খলতায় নিমজ্জিত হয়েছিল- লেখক এই প্রহসনে সে রকম একটি ঘটনাই তুলে ধরেছেন। স্বামী রাধাকান্ত, স্ত্রী মুক্তকেশী, রক্ষিতা নয়নতারা, ইয়ার মদন প্রমুখ এর উল্লেখযোগ্য চরিত্র। গ্রন্থটির প্রকাশ ঘটে ১৮৭৫ সারে, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৮৯২ সালে। সমকালে প্রহসনটি সমাদৃত হয়েছিল। এই প্রহসনে মধুসূদন দত্তের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’র প্রভাব রয়েছে।
প্র : ‘বসন্তকুমারী নাটক’ গ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : মীর মশাররফের ‘বসন্তকুমারী নাটক’ (১৮৭৩)-এর বিষয়ব্সুত এরকম : বৃদ্ধ রাজা বীরেন্দ্র সিংহের যুবতী স্ত্রী রেবতী সপতœী-পুত্র নরেন্দ্র সিংহকে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয় এবং ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর পরিণামে সগ্র রাজপরিবারটি ধ্বংস হয়ে যায়। তিনটি অঙ্ক, নটনটীর প্রস্তাবনাসহ তেরটি দৃশ্য; প্রস্তাবনার একটিসহ সর্বমোট আটটি গান রয়েছে নাটকটিতে। নামকরণে মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী নাটক’-এর প্রভাব আছে।
প্র : ‘জমীদার দর্পণ’ নাটকের পরিচয় দাও।
উ : অত্যাচারী ও চরিত্রহীন জমিদার হায়ওয়ান আলীর অত্যাচার এবং অধীনস্থ প্রজা আবু মোল্লা গর্ভবতী স্ত্রী নূরন্নেহারকে ধর্ষণ ও হত্যার কাহিনি ‘জমীদার দর্পণ’ (১৮৭৩)-এ রমূল ঘটনা। মশাররফ হোসেন লিখেছেন, নাটকটির ‘কিচুই সাজানো নয়, অবিকল ছবি’ তুলে ধরা হয়েছে প্রচলিত সমাজের। ওই সময় মুসলিমগণ বাংলা চর্চায় এগিয়ে এসেছে কমই। এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় নাটকটির প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘অনেক হিন্দুর প্রণীত বাঙ্গালার অপেক্ষা এই মুসলমান লেখকের বাঙ্গালা পরিশুদ্ধ’। নামকরণে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল-দর্পণে’র প্রভাব যেমন প্রবল নাটকটির ঘটনাবিন্যাসেও এর কম ছায়া পড়ে নি।
প্র : ‘বিষাদ-সিন্ধু’ গ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : মশাররফ হোসেনের খ্যাতি মূলত এ গ্রন্থটির জন্যেই। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ (১৮৮৫-’৯১) একটি ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস। হাসান ও হোসেনের সঙ্গে দামেস্ক অধিপতি মাবিয়ার একমাত্র পুত্র এজিদের কারবালা প্রান্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং ইমাম হাসান-হোসেনের করুণ মৃত্যুকাহিনি ‘বিষাদ-সিন্ধু’ গ্রন্থে বর্ণিত মূল বিষয়। মূল ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা থাকলেও গ্রন্থটিতে ইতিহাসের অন্ধ অনুসরণ করা হয় নি। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসটি ‘মহরম পর্ব্ব’ (১৮৮৫), ‘উদ্ধার পর্ব্ব’ (১৮৮৭) ও ‘এজিদ-বধ পর্ব্ব’ (১৮৯১) এই তিনটি পর্বে সম্পন্ন হয়েছে। গ্রন্থটি উপক্রমণিকা ও উপসংহারসহ মোট তেষট্টিটি ‘প্রবাহ’ অর্থাৎ অধ্যায় নিয়ে লিখিত। তন্মধ্যে ‘মহরম পর্ব্বে’ উপক্রমণিকা ও ছাব্বিশটি প্রবাহ, ‘উদ্ধার পর্ব্বে’ ত্রিশটি প্রবাহ, ‘এজিদ-বধ পর্ব্বে’ পাঁচটি প্রবাহ ও উপসংহার-অংশ রয়েছ।
প্রথমত ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত সম্পর্শকাতর কাহিনি সাধারণ মুসলিম পাঠকের কাছে এর জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। দ্বিতয়িত ‘বিষাদ-সিন্ধু’র জাদুকরী রচনাগুণের জন্যে সাহিত্যরসিকজনের কাছেও গ্রন্থটি আদরণীয়। জয়নাবের রূপে বিমোহিত এজিদ এবং এই রূপতৃষ্ণার পরিণামে বহু মানুষের বিপর্যয় ও ধ্বংসের যে কথকতা বর্ণিত হয়েছে তা গ্রন্থটিকে সর্বজনীন করে তুলেছে। ‘বিষাদ-সিন্ধু’র কাহিনিতে অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট চেতনা মূলত মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ থেকেই মশাররফ হোসেন গ্রহণ করেছেন।
প্র : ‘গো-জীবন’ গ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : মীর মশাররফ হোসেনর ‘গো-জীবন’ (১৮৮৯) একটি প্রবন্ধ পুস্তিকা। প্রবন্ধটির মূল বক্তব্য হলো, কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে যে কোনো কারণেই হোক গো-হত্যা অনুচিত। স্বীয় বক্তব্যের সমর্থনে লেখক ধর্মগ্রস্থ এবং প্রাত্যহিক-বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নানা যুক্তি ও তথ্য পরিবেশন করেছেন। হিন্দু ও মুসলমান এই দুই ধর্মাবলম্বীদের ঐক্যবদ্ধ করা মানসেই মশাররফ হোসেন এ প্রবন্ধ রচনা করেন। প্রবন্ধটি তৎকালে মুসলিম ধর্মীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া জন্ম দেয়্ এ কারণে ‘আখবারে এসলামিয়া’ (১৮৮৪) পত্রিকা প্রতিবাদ প্রকাশ করে এবং লেখককে পরে মামলাতে জড়িয়ে পড়তে হয়। অবশেষে মৌলবাদী মুসলিমদের প্রবল চাপের মুখে তিনি ‘গো-জীবন’ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
প্র : ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ গ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : ‘উদাসীন পথিক’ এই ছদ্মনামে মশাররফ হোসেন ব্যক্তিগত জীবনের পটভূমিতে স্বীয় পারিবারিক ইতিহাস ও সমসাময়িক বাস্তব ঘটনার চিত্র তুলে ধরেছেন এ গ্রন্থে। ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯০) কে প্রকৃতপক্ষে উপন্যাস কিংবা আত্মজীবনীমূলক রচনা এর কোনোটাই বলা যায় না। বরং বলতে হয়, গ্রন্থটি লেখকের আত্মজীবননির্ভর কতিপয় বাস্তব ও কাল্পনিক ঘটনার মিশেল উপন্যাসসুলভ সাহিত্যিক উপস্থাপনা। এতে লেখকের পারিবারিক ইতিবৃত্ত বর্ণনা এবং নিজের মাতা-পিতাকে যথেষ্ট ম্রদ্ধার সঙ্গে চিত্রিত হতে দেখা যায়। উদাসীন পথিকের মনের কথায় হিন্দু-মুসলমানের যে মিলন-কামনা আছে তার গভীর তাৎপর্য স্বীকার করতে হয়।
প্র : ‘গাজী মিয়াঁর বস্তানী’ গ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : ‘গাজী মিয়াঁর বস্তানী’ (১৯০০) মশাররফ হোসেনের কর্মজীবন নির্ভর আত্মজীবনীমূলক রচনা। লেখক ব্যঙ্গের মাধ্যমে সমাজের অন্যায়, অনাচার, সামাজিক দুর্নীতি এবং সেই সমাজভুক্ত মানুষগুলোর নৈতিক অধঃপতন, মনুষ্যত্ব ও হৃদয়হীন আচরণ তুলে ধরেছে এ গ্রন্থে। লেখক নিজেকে ‘ভেড়াকান্ত’ নামে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া আলকাতরা সান্যাল, কটা পেস্কার, জয়ঢাক, ছিড়িয়া খাতুন, অরাজকপুর, নচ্ছারপুর, জমদ্বারগ্রাম ইত্যাদি নামচয়নের মধ্যেও লেখকের ব্যঙ্গের তীব্রতা লক্ষ করা যায়। এই ব্যঙ্গ সম্প্রদায় নির্বিশেষে, সকল কলুষ ও মালিন্যের বিরুদ্ধে। গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর প্রভাব লক্ষ করা যায়।
প্র : ‘আমার জীবনী’ গ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : ‘আমার জীবনী’ বারো খন্ডে সমাপ্ত। খন্ডগুলো পৃথক পৃথকভাবে ১৯০৮ থেকে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত হয। মীর মশাররফ হোসেনের আত্মজীবনমূলক রচনা ‘আমার জীবনী’। কিন্তু গ্রন্থটিতে তাঁর পরিপূর্ণ জীবন কাহিনি বর্ণিত হয় নি। লেখকের জীবনের মাত্র আঠার বছরের ঘটনা ও কার্যক্রম এতে তুলে ধরা হয়েছে। সে বিচারে আত্মজীবনীটি অসমাপ্ত।
প্র : ‘কুলসুম জীবনী’ গ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : ‘কুলসুম জীবনী’ (১৯১০) গ্রন্থটিকে লেখক ‘আমার জীবনীর জীবনী কুলসুম জীবনী’ নামে অভিহিত করেছেন। এটি মশাররফ হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী বিবি কুলসুমকে কেন্দ্র করে লিখিত। গ্রন্থটিতে লেখক বিবি কুলসুম সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। যেহেতু বিবি কুলসুম ও লেখক একে অপরকে গভীরভাবে ভারোবাসতেন, সেহেতু বিবি কুলসুম প্রসঙ্গে বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক স্বাভাবিকভাবেই নিজের কথা বলেছেন। এদিক থেকে ‘কুলসুম জীবনী’ ‘আমার জীবনী’ গ্রন্থের পরিপূরক বলা চলে। এ কারণে ‘আত্মজীবনী’ না হয়েও গ্রন্থটি মশাররফ হোসেনের আত্মজীবনীনির্ভর রচনার অন্তর্ভুক্ত।
প্র : তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা কোনটি?
উ : বিষাদ-সিন্ধু (১৮৮৫-৯১) উপন্যাস।
প্র : গো-জীবন (১৮৮৯) কেমন রচনা।
উ : প্রবন্ধগ্রন্থ। এই গ্রন্থ রচনার দায়ে তাঁকে মামলায় জড়িয়ে পড়তে হয়।
প্র : মীরের দুটি উল্লেখযোগ্য নাটকের নাম লেখ।
উ : ‘বসন্তকুমারী’ (১৮৭৩) ও ‘জমীদার দর্পণ’ (১৮৭৩)।
প্র : মশাররফ হোসেন কোন ছদ্মনামে লিখতেন?
উ : গাজী মিয়াঁ।
প্র : গাজী মিয়াঁর বস্তানী (১৮৯৯) কী ধরনের গ্রন্থ?
উ : আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসোপম রচনা।
প্র : মশাররফের দুটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের নাম লেখ।
উ : আমার জীবনী (১৯১০), কুলসুম জীবনী (১৯১০)।
প্র : মীর মশাররফ হোসেনের বিশিষ্টতা কীসে?
উ : বিষয়ে নয়, বঙ্কিম সমকালে ভিন্ন গদ্যশৈলীর জন্যই তিনি বিশিষ্ট।
প্র : মীর মশাররফ হোসেনে সম্পাদিত পত্রিকার পরিচয় দাও।
উ : মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত মাসিক ‘আজীজন নেহার’ এই পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৪ সালে। মুসলমানদের সাহিত্যচর্চার জন্য পত্রিকা প্রকাশ ও সংগঠনের প্রয়োজনয়িতা উপলব্ধি করে পত্রিকাটির যাত্রা শুরু হলেও মুসলমান পরিচারিত পত্রিকার লেখক ও পাঠকের অভাব সহ বিভিন্ন কারণে পত্রিকাটি বেশি দিন চলে নি। মনে করা হয়, মশাররফ হোসেন তাঁর প্রতশ স্ত্রীর নামে এই পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন। এই পত্রিকাটি বিলুপ্ত হলে তিনি ‘হিতকরী’ (১৮৯০) নামে অন্য একটি স্বল্পায়ু পাক্ষিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
প্র : মীর মশাররফের মৃত্যু তারিখ কত?
উ : ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে ডিসেম্বর।