প্র : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবে, কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
উ : ১৮৭৬ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৩ই ভাদ্র ১২৮৩, হুগলির দেবানন্দপুর গ্রামে।
প্র : তিনি মূরত কী হিসেবে পরিচিত?
উ : অপরাজেয় কথাসাহিত্যিক।
প্র : তাঁর পিতার নাম কী ছিল?
উ : মতিলাল চট্টোপাধ্যায়।
প্র : তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কতটুকু?
উ : তিনি ভাগলপুর দুর্গাচরণ এম.ই স্কুল থেকে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ (১৮৮৭), টি.এন. জুবলি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস (১৮৯৪), এরপর দারিদ্র্যের জন্য লেখাপড়া হয় নি।
প্র : তিনি কত সালে জীবিকার তাগিদে রেঙ্গুনে গমন করেন?
উ : ১৯০৩ সালে।
প্র : শরৎচন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত গল্পে নাম কী?
উ : মন্দির।
প্র : তিনি ‘মন্দির’ গল্পের জন্য কোন পুরস্কার লাভ করেন?
উ : কুন্তলীন পুরস্কার (১৯০৩)।
প্র : ‘ভারতী’ পত্রিকায় কোন উপন্যাস প্রকাশিত হলে তাঁর সাহিত্য খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে?
উ : বড়দিদি (১৯০৭)।
প্র : শরৎচন্দ্র এক মহিলা নামেও লিখেছেন, সেটি কি?
উ : অনিলা দেবী। (দ্র. নারীর মূল্য)
প্র : তাঁর কথাসাহিত্যে কোন দিকটি উজ্জ্বলভাবে রূপায়িত হয়েছে?
উ : গার্হস্থ্য ও সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি।
প্র : শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে কোন সংঘাতের চিত্র অসাধারণভাবে শিল্প কুশলতার সঙ্গে অঙ্কিত?
উ : মানুষের অন্তরে তার দর্শীয় ও সামাজিক বিশ্বাস-সংস্কারের সঙ্গে প্রণয়াকাক্সক্ষার যে নিরন্তর দ্বন্দ্ব।
প্র : কোন উপন্যাসটিকে লেখকের আত্মজৈবনিক বলা হয়?
উ : শ্রীকান্ত।
প্র : ম্রীকান্ত কত খন্ড?
উ : ৪ খন্ড। প্রকাশ : ১৯১৭, ১৯১৮, ১৯২৭, ১৯৩৩।
প্র : তাঁর প্রকাশিত অন্য উপন্যাসগুলোর নাম কী?
উ : পরিণীতা (১৯১৪), বিরাজ বৌ (১৯১৪), পল্লী সমাজ (১৯১৬), দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), দত্তা (১৯১৮), গৃহদাহ (১৯২০), বামুনের মেয়ে (১৯২০), দেনা পাওনা (১৯২৩), পথের দাবী (১৯২৬), শেষ প্রশ্ন (১৯৩১), বিপ্রদাস (১৯৩৫) ইত্যাদি।
প্র : ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘ম্রীকান্ত’ শরৎচন্দ্রের আত্মজৈবনিক উপন্যাস। এর চারটি খন্ড। ১ম খন্ড ১৯১৭, ২য় খন্ড ১৯১৮, ৩য় খন্ড ১৯২৭, ৪র্ত খন্ড ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয। ১ম খন্ড মাসিক ‘ভারতবর্ষে’ (১৯১৬-১৭) ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী’ নামে প্রকাশ পায়। লেখকের নাম মুদ্রিত হয় ‘শ্রীম্রীকান্ত শর্মা’। ২য় ও ৩য় খন্ডও ‘ভারতবর্ষে’ প্রকাশ পায়্ তবে ৪র্থ খন্ড প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায়। ১ম খন্ডে বারক শ্রকিান্তের নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন। খন্ডটি যখন শেষ হয় তখন শ্রীকান্তের মনে হলো : ‘বড় প্রেম শুদু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেব।’ এই খন্ডের উল্লেখযোগ্য চরিত্র : শ্রীকান্ত, ইন্দ্রনাথ, অন্নদাদিদি, রাজলক্ষ্মী (পিয়ারী)। ২য় খন্ডে যুবক শ্রীকান্তের রেঙ্গুন যাত্রার জীবন্ত উপস্থাপনা আছে। এই অংশে শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর আন্তরিকতা অন্যদের সম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এইখন্ডের উল্লেখযোগ্য চরিত্র : শ্রীকèাত, অভয়া, রোহিণী, গুরুদেব, রাজলক্ষ্মী। ৩য় খন্ডে অসুস্থ শ্রীকান্ত রাজলক্ষ্মীর শুশ্রƒষায় সুস্থ হলেও তাদের মধ্যে আবার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। শ্রীকান্ত তাই রেঙ্গুনে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। যাবার আগে রাজলক্ষ্মীর কাছে বিদায় নিয়ে এসে দেখে রাজলক্ষ্মীর সন্ন্যাসিনীর বেশ। এখন্ডের উল্লেখযোগ্য চরিত্র : শ্রীকান্ত, যদুনাথ, সুনন্দা, কুশারী, রাজলক্ষ্মী। ৪র্থ খন্ডে শ্রীকান্তের সঙ্গে পুঁটুর বিয়ের দিন ধার্য, রাজলক্ষ্মীর সন্ন্যাসিনীর বেশ ত্যাগ করে সাধারণ পোশাক গ্রহণ কমললতা কর্তৃক শ্রীকান্তকে ভালোবাসার কথা ব্যক্ত ও মৃত্যুপথযাত্রী গহরকে সেবা করার কাহিনি আছে। উপন্যাসটি শেষ হয় কমললতার নিরুদ্দেশ যাত্রার মধ্য দিয়ে। এখন্ডের উ্েলখযোগ্য চরিত্র : শ্রীকান্ত, ঠাকুর্দা, পুঁটু, গহর, কমললতা, রাজলক্ষ্মী।
প্র : ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম খন্ড (১৯১৭) উপন্যাসের সূচনা ‘বাঙালী ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ’-এর বর্ণনা দিয়ে। এ নিয়ে শরৎচন্দ্রের অনেক বিরূপ সমারোচনা করা হয়। প্রকৃত ঘটনা কী?
উ : শরৎচন্দ্র বাস্তবঘনিষ্ঠ লেক। বাস্তবতার হুবহু অনুকৃতি তাঁর লেখার প্রাণ। বাস্তবতা উল্লেখের কষাঘাত থেকে হিন্দু কুলীনদেরও তিনি মুক্তি দেন নি। ‘বাঙালী ও মুসলমান’ ছাত্রদের ফুটবল খেলার প্রকৃত বাস্তবতা অনুসন্দান করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সফিকুন্নবী সামাদী ওই অঞ্চলে গিয়ে। পিএইচ.ডি. গবেষণাকালে তিনি বুঝতে চেয়েছেন কেন শরৎচন্দ্র ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে (১৯১৭) এমন লিখলেন? এ-প্রসঙ্গে পিএইচ.ডি. অভিসন্দর্ভে তাঁর পর্যবেক্ষণ : ‘তৎকালীন বাঙালার সামাজিক প্রবণতাই ছিল এরকম। বাঙালি হিন্দু বাঙালি মুসলমানকে বহিরাগত ভাবত। আর কিছু সংখ্যক বাঙালি মুসলমানও নিজেকে বাঙালি না ভেবে আরব-ইরান-তুরানের বংশোদ্ভূত ভাবতে ভালোবাসত, গর্ববোধ করত। এ্ মিনোভাব বর্তমান কালেও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। শরৎচন্দ্র এই সামাজিক সত্যের বিশ্বস্ত উপস্থাপন করেছেন মাত্র। এছাড়া ্ িেবষয়ে আরও একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্বের প্রথম দিককার এই গল্প ভাগলপুরের পটভূমিকায়। তৎকালনি ভাগলপুরের মুসলিমরা প্রকৃতই বাঙালি ছিল না, অধিকাংশই উর্দুভাষী, কিছু কিছু ছিল ভোজপুরী। আর অধিকাংশ হিন্দু ছিল বাঙালি হিন্দু। ফলে শরৎচন্দ্রের বর্ণনায় এই সামাজিক সত্যটির ছায়াপাত অসম্ভব নয়, অস্বাভাবিক নয়।’ (সূত্র : কথাসাহিত্যে বাস্তবতা : শরৎচন্দ্র ও প্রেমচন্দ্র, ১৯৯৭, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ. ১২৫)।
প্র : ‘অনুরাধা সতী ও পরেশ’ গ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : ‘অনুরাধা সতী ও পরেশ’ (১৯৩৪) ছরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখিত তিনটি গ্রন্থের সংগ্রহ। ‘অনুরাধা’ ভারতবর্ষে, ‘সতী’ বঙ্গবাণীতে এবং ‘পরেশ’ ‘শরতের ফুল’ নামক সাময়িকীর পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয়। তিনটি রচনারই বিষয় প্রেম এবং পারিবারিক দ্বন্দ্ব। ‘সতী’ গল্পটি শরৎরচনার ব্যতিক্রম। এক সতীসাধ্বী কিন্তু সন্দেহপরায়ণা স্ত্রী এই কাহিনির নায়িকা। অন্যদিকে পূর্ণাঙ্গ গল্প হিসেবে শরৎ-সাহিত্যে ‘অনুরাধা’ সর্বশেষ গল্প। ‘পরেশ’ গল্পের প্রধান চরিত্র গুরুচরণের নামে এর নামকরণ হতে পারত।
প্র : ‘ছবি’ গল্পগ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : ‘ছবি’ (১৯২০) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত গল্পগ্রন্থ। ছবি, বিলাসী ও মামলার ফল এই তিনটি গল্পের সংকলন। ‘ছবি’ গল্পের ঘটনাস্থল ব্রহ্মদেশ। চিত্রকর বা-থিন এবং ধনীকন্যা মাশায়ের গভীর প্রেম এই গল্পের বিষয়বস্তু। ‘বিলাসী’ গল্পে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধাচরণ করা হয়েছে মৃত্যুঞ্জ-বিলাসীর বিয়ে সংঘটনের মাধ্যমে। গল্পের ন্যাড়া চরিত্র আসলে লেখক নিজেই। ‘মামলার ফর’ গল্পে দুই ভাইয়ের (শিবু ও শম্ভু) মামলায় নিঃসন্তান সঙ্গামণির অপত্য হ্লে শিশু গয়ারামকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়েছে।
প্র : ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘চরিত্রহীন’ (১৯১৭) প্রথমে ‘যমুনা’ পত্রিকায় কিছুটা প্রকাশিত হয্ প্রথম বহির্ভূত প্রেম ও নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে রচিত এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে এক সময় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সতীশ ও সাবিত্রী, দিবাকর ও কিরণময়ীর তৎকালনি এবং বর্তমান সমাজ াননুমোদিত সম্পর্ক কাহিনির মুখ্য আকর্ষণ। উপন্যাসের নামকরণ তাই ‘চরিত্রহীন’।
প্র : ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘গৃহদাহ’ (১৯২০) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক রচিত একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। মাসিক ‘ভারতবর্ষে’ প্রকাশিত হয়্ মহিম ও সুরেশ দুই পুরুষের প্রতি অচলার আকর্ষণ-বিকর্ষণ এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় উপকরণ। বিবাহ-বহির্ভূত কথিত অসামাজিক প্রেমের কাহিনিটি নিপুণ ঘটনা সংস্থানে ও বর্ণনার মনস্তাত্ত্বিক সূক্ষ্মতার দ্বারা সমস্যায়িত হয়ে উঠেছে। এই উপন্যাসে শরৎচন্দ্র হিন্দু বিধবা মৃণালকে আদর্শ হিসেবে রূপায়িত করেছেন।
প্র : ‘দত্তা’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘দত্তা’ (১৯১৮) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত সুখপাঠ্য প্রেমের উপন্যাস। ১৩২৪-’২৫ বঙ্গাব্দে ‘ভারতবর্ষে’ প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি ‘বিজয়া’ (১৯৪৩) নামে নাট্যায়িত হয়। উল্লেখযোগ্য চরিত্র : বিজয়া, নরেন, রাসবিহারী, বনমাল।ি
প্র : ‘অরক্ষণীয়া’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত সামাজিক ও পারিবারিক জীবন সমস্যামূলক এই উপন্যাসটি মাসিক ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ১৩২৩ বঙ্গাব্দের আশ্বিরন সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়। পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৬১ সালে। জ্ঞানদার বিয়ে, স্বামীর অত্যাচার, মামীর কলহপূর্ণ আচরণ এবং তার প্রতি স্নেহের বহিঃপ্রকাশ, বিধবা দুর্গামণি তার কন্যা জ্ঞানদাকে বাঁচানোর চেষ্টা ইত্যাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার সংযুক্তিতে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাসের কাহিনি।
প্র : ‘দেনাপাওনা’ উপন্যাসের পরিচায় দাও।
উ : ‘দেনাপাওনা’ (১৯২৩) শরৎন্দ্রের অন্যান্য উপন্যাসের মতোই নারীপুরুষের সম্পর্ক, নারীত্ব ও সতীত্বের ধারণার বিচার এই আখ্যানের মূলসূত্র। কাহিনির নায়ক জীবনানন্দ শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট চরিত্রগুলির অন্যতম। এই উপন্যাস ‘ষোড়শী’ (১৩২৭) নামে নাট্যায়িত হয় এবং মঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়্
প্র : ‘দেবদাস’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘দেবদাস’ (১৯১৭) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় দেবদাস তার বাল্যপ্রণয়ী পার্বতীকে বিয়ে করতে ব্যর্থ হয়্ সেই ব্যর্থতায় নিজেকে বিয়ে করতে ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থতায় নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করার বেদনাময় কাহিনি। এই উপন্যাস সমস্ত ভারতবর্ষে জনপ্রিয় হয়। দেবদাস ও পাবর্তী আধুনিক ভারতীয় জীবনে ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকার রূপকে পরিণত করেছে। বাংলায় বহুবার এর চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। ২০০৪ সালে হিন্দি ভাষায় চলচ্চিত্রায়িত হয়ে বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগায়। এর পরিচালক ছিরেন সঞ্জয় লীলা বংশালী। উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র : দেবদাস, পার্বতী (পারু), চন্দ্রমুখী, চুনিলাল, ধর্মদাস।
প্র : ‘নারীর মূল্য’ সম্পর্কে লেখ।
উ : ‘নারীর মূল্য’ (১৯২৩) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত নারীর সামাজিক অধিকার ও সমাজে নারীর স্থান সম্পর্কিত মূল্যবান নিবন্ধ গ্রন্থ। ‘অনিলা দেবী’ ছদ্মনামে ‘যমুনা’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। অনিলা দেবী শরৎচন্দ্রের বড়দিদির নাম।
প্র : ‘নিস্কৃতি’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘নিস্কৃতি’ (১৯১৭) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ক্ষুদ্র উপন্যাস। এর প্রথমাংশ ‘ঘরভাঙা’ নামে ‘যমুনা’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে বিরোধ ও শেষ পর্যন্ত সম্প্রীতি এই কাহিনির উপজীব্য। উল্লেখযোগ্য চরিত্র : গিরিশ, রমেশ, সিদ্ধেশ্বরী, শৈলজা প্রমুখ। ১৯৪৪ সালে Deliverance নামে দিলপিকুমার রায়ের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
প্র : ‘প্রথের দাবী’ কোন ধরনের উপন্যাস?
উ : ‘পথের দাবী’ (১৯২৬) রাজনৈতিক উপন্যাস। স্বদেশী বিপ্লবীদের হাতে হাতে থাক। কাহিনর পটভূমিকা ব্রহ্মদেশ। এক গুপ্ত বিপ্লবী দরের নায়ক সব্যসাচী এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। কারো কারো মতে সব্যসাচী চরিত্রে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ছায়াপাত ঘটেছে। নিঃসন্দেহে এই কাহিনিতে ব্রিটিশ শাসনের তীব্র সমালোচনা এবং সশস্ত্র বিপ্লবকে আন্তরিক সমর্থন আছে। গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়্ নান্দনিক মানদ-ে ‘পতের দাবী’ উৎকৃষ্ট সাহিত্য কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সঙগ্রামে এ উপন্যাস উদ্দীপকের ভূমিকা রাখে। ‘আমি বিপ্লবী, ভারতের স্বাধীনতাই আমার একমাত্র কাম্য, আমার একটিমাত্র সাধনা।’ এই ব্যক্তব্য ছিল উপন্যাসের শেষে। ভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই গ্রন্থ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় ১৩২৯-এর ফাল্গুন সংখ্যা থেকে ‘পথের দাবী’ ধারাবাহিকরূপে প্রকাশিত হয়।
প্র : ‘পল্লীসমাজ’-এর পরিচয় দাও।
উ : ‘পল্লীসমাজ’ (১৯১৬) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। বাংরার পল্লীজীবনের নীচতা ও ক্ষুদ্র রাজনীতির পটভূমিকায় এক আদর্শবাদী যুবক-যুবতীর সম্পর্ক ও বিশেষ করে তাদের অভিশপ্ত প্রেমকাহিনি এই উপন্যাসের মূল বিষয়্ ১৯১৫ সালে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এর নাট্যরূপ ‘রমা’ (১৯২৮) বাংলা রঙ্গমঞ্চে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। প্রধান চরিত্র : রমা, রমেশ, বেণী, বলরাম।
প্র : শরৎচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস ‘বড়দিদি’র পরিচয় দাও।
উ : ‘বড়দিদি’ (১৯১৩) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত প্রথম মুদ্রিত উপন্যাস। এই উপন্যাসটি সরলা দেবী সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশকালে বাংলা সাহিত্যে আলোড়নের সৃষ্টি করে। প্রথমে এর নাম ছিল ‘শিশু’। শরৎ উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ, নারীচরিত্রের সংগম ও মাধুর্য, শাস্ত্রশাসিতত জীবন ও স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মধ্যে টানাপোড়েন এবং সহজ সাবলীল ভাষা-সবই এখানে পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত। উল্লেখযোগ্য চরিত্র : সুরেন্দ্রনাথ, ব্রজরাজ, মাধবী, প্রমীলা। বড়দিদি ‘মাধবী’র নাম।
প্র : ‘বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : ‘বিন্দুর ছেলে’ ‘রামের সুমতি’ ও ‘পথনির্দেশ’ এই তিনটি গল্পের সংকলন ‘বিন্দুর ছেলেও অন্যান্য গল্প’ (১৯১৪)। এই গল্পগুলি ‘যমুনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়্ প্রত্যেকটি গল্পে শরৎচন্দ্রের আখ্যান রচনার স্বাভাবিক নৈপুণ্য আছে গল্পগুলি শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয় রচনার অন্যতম।
প্র : ‘বিপ্রদাস’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘বিপ্রদাস’ (১৯৩৫) জনপ্রিয় এবং সুখপাঠ্য উপন্যাস। বিপ্রদাস, দ্বিজদাস, বন্দনা প্রভৃতি চরিত্র এবং তাদের মানবিক সম্পর্কে জটলতা এবং মাধুর্য, কাহিনীর টানাপোড়েন এবং পরিণাম-রমণীয়তা এই উপন্যাসটিকে বিশেষ জনপ্রিয় করেছিল। সমগ্র ‘বিপ্রদাস’ ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। শরৎচন্দ্রের জীবদ্দশায় প্রকাশিত সর্বশেষ উপন্যাসগ্রন্থ।
প্র : ‘বরাজ বৌ’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘বিরাজ বৌ’ (১৯১৪) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত জনপ্রিয় এবং পুস্তক আকারে দ্বিতীয় প্রকাশিত উপন্যাস। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে। বাঙালি গৃহস্থ জীবনের বাস্তব ছবি এবং বাঙালি নারীর মমত্ব ও কারুণ্যের রূপায়ণের জন্য এই উপন্যাস ভাবাকুলতা সত্ত্বেও অভিনন্দিত হয়। সুন্দরী বিরাজ বৌয়ের নাম সমস্যা এ উপন্যাসের বিষয়।
প্র : ‘মেজদিদি’ গল্পগ্রন্থের পরিচয় দাও।
উ : ‘মেজদিদি’ (১৯১৫) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মেজদিদি’ (১৯১৪), ‘দর্পচূর্ণ’ (১৯১৪) ও ‘আঁধারে আলো (১৯১৪) এই তিনটি গল্পের সংকলন। ‘মেজদিদি’ শরৎচন্দ্রের অন্যতম জনপ্রিয় রচনা। তিনটি রচনাই চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। এই গ্রন্থে নারীর মহত্ত্বের পাশাপাশি ‘স্বামীর কাছে স্ত্রীর অহংকার সাজে না’ এই বক্তব্যও প্রকাশিত।
প্র : ‘শেষপ্রশ্ন’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : ‘শেষপ্রশ্ন’ (১৯৩১) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বিতর্কপ্রধান ও সমস্যামূলক উপন্যাস। শরৎচন্দ্রের মূল উপন্যাস ধারা থেকে এটি কিছুটা পৃথক। উনপ্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র কমল। বাস্তব অপেক্ষা আদর্শের দ্বারা এই চরিত্র রূপায়িত হয়েছে। কমল কোনো সংস্কার ও ঐতিহ্যকে স্বীকার করে না, জীবনে কোনো কিছুকেই তর্কাতীত ও শাশ্বত বলে মানে না। সম্পূর্ণ নূতন ধরনের নারীচরিত্র রচনার জন্য এই উপন্যাস স্মরণীয়। শিবনাথ-মনোরমা, অজিত-কমল, নীলিমা-আশুবাবুর প্রণয়ের নানা-মাত্রা এখানে প্রকাশিত।
প্র : ‘শেষের পরিচয়’ উপন্যাস সম্পর্কে লেখ।
উ : ‘শেষের পরিচয়’ (১৯৩৯) শরৎচন্দ্র মৃত্যুর পূর্বে শেষ করতে পারেন নি। পঞ্চদশ পরিচ্ছেদের ‘রাখাল এ প্রশ্নে নীরবে বাহির হইয়া গেল’ পর্যন্ত শরৎচন্দ্রের রচনা। বাকি অংশ রাধারানী দেবী কর্তৃক রচিত। উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল।
প্র : শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলি নারী চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য কর।
উ : শরৎ-উপন্যাসগুলিতে নারীর যে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় তা জীবনকেন্দ্র থেকেই সংকরিত। সুতীব্র অভিমান ও সর্বব্যাপী কর্তৃত্বের মধ্যে এই নারী আপন ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সর্বত্যাগী এক সন্ন্রাসিনী মূর্তি। প্রেমের আকুলতায় যে নারী সমাজনীতিকে আঘাত করে, সন্তানøেহে যে নারীচিত্ত শতধারায় প্লাবিত, ব্যক্তিগত জীবনে নিত্য উপবাস, ব্রত, ভোগের উপকরণ থেকে আত্মবঞ্চনার বিচিত্র সাধনা আছে এখানে।
প্র : গল্পকার হিসেবে তাঁর কোন গল্পগুলো খ্যাত?
উ : মহেশ, বিলাসী, সতী, মালমাল ফল ইত্যাদি এবং রামের সুমতি (১৯১৪), মেজদিদি (১৯১৫), বিন্দুর ছেলে (১৯১৪), ছবি (১৯২০) ইত্যাদি তাঁর সুখপাঠ্য বড়গল্প।
প্র : বিলাসী গল্পে ন্যাড়া চরিত্রের মধ্যে কার ছায়াপাত ঘটেছে?
উ : শরৎচন্দ্রের নিজের।
প্র : তাঁর কোন উপন্যাস সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়?
উ : ‘পথের দাবী’।
প্র : তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থগুলির নাম কী?
উ : তরুণের বিদ্রোহ (১৯২৯) এবং স্বদেশ ও সাহিত্য (১৯২৩)।
প্র : শরৎচন্দ্র কোন কোন উপন্যাস মৃত্যুর পূর্বে অসমাপ্ত রেখে যান?
উ : ‘শেষের পরিচয়’ (ভারতবর্ষে প্রকাশিত হয়), ‘আগামীকাল’ (বিচিত্রা পত্রিকায়), ‘জাগরণ’ (বসুমতী পত্রিকায়)। এর মধ্যে ‘শেষের পরিচয়’ অধিকতর বিস্তৃত ছিল।
প্র : শরৎচন্দ্র কয়টি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন?
উ : সাতটি। এগুলো হলো : অনিলা দেবী; অপরাজিতা দেবী; শ্রী চট্টোপাধ্যায়; অনুরূপা দেবী; পরশুরাম (পরশুরাম রাজশেখর বসুরও ছদ্মনাম। সাহিত্যসমাজের রাজশেখর বসুই এ নামে অধিক পরিচিতি।); শ্রীকান্ত শর্মা; সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
প্র : তিনি কী কী পুরস্কার লাভ করেন?
উ : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (১৯২৩) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট (১৯৩৬) উপাধি লাভ। উল্লেখ্য, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর মাতার নামে জগত্তারিণী পদক প্রবর্তন করেন।
প্র : তিনি কত সালে মৃত্যুবরণ করেন?
উ : কলকাতা; ১৬ই জানুয়ারি ১৯৩৮; ২রা মাঘ ১৩৪৪।