উ : সেলিম আল দীনের প্রকৃত নাম কী?
প্র : মইনুদ্দিন আহমেদ।
উ : তাঁর মাতা-পিতার নাম কী?
প্র : মাতা-ফিরোজা খাতুন, পিতা-মফিজ উদ্দিন আহমেদ।
উ : তিনি কত সালে কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
প্র : ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই নভেম্বর তৎকালীন নোয়াখালি জেলার (বর্তমান ফেনি) সোনাগাজির সেনেরখিল গ্রামে। (সুত্র : বাংলা একাডেমী লেখক অভিধান : ১৯৯৮ : পৃষ্ঠা ২০৯)
উ : কর্মজীবনে তিনি কোন প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ত ছিলেন?
প্র : ১৯৮৮ খ্রিষ্টা পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা, পরে এইক প্রতিষ্ঠানে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রারম্ভকালীন অধ্যাপক।
প্র: তিনি কোনো নাট্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কী?
উ : তিনি ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
প্র : সেলিম আল দীনের কয়েকটি গ্রন্থের নাম লেখ।
উ : নাট্যগ্রন্থ : সর্প বিষয়ক গল্প ও অন্যান্য (১৯৩৭); বাসন (১৯৮২); কেরামতমঙ্গল (১৯৮৩); কর্তিন খোলা (১৯৮৩); মুনতাসীর ফ্যান্টাসি (১৯৮৫); চাকা (১৯৯০); যৈবতী কন্যার মন (১৯৯২);, বনপাংশু (১৯৯১); হরগজ (১৯৯২); একটি মারমা রূপকথা (১৯৯৫); হাতহদাই (১৯৯৭); নিমজ্জন ইত্যাদি।
গবেষনা গ্রন্থ : মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য (১৯৯৭)।
প্র : সেলিম আল দীনের নাট্যচর্চা কিভাবে আরম্ভ হয়?
উ : সেরিম আল দীন কবিতাই লিখতেন। কিন্তু ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর রচিত ‘নীল শয়তান : তাহিতি ইত্যাদি’ নাটকটি টেলিভিশন ও বেতারে প্রচার হলে তাঁর নাট্যরচনার কথা জানাজানি হয়্ একই বছর ডাকসু মঞ্চস্থ করে ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলু’ এবং নাট্য প্রতিযোগিতাতেও নাটকটি প্রথম পুরস্কার পায়। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ডাকসু নাট্যচক্র তাঁর লেখা ‘এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা’ মঞ্চস্থ করলে নাট্যকার হিসেবে সেলিম আল দীন সবার পরিচিতি পান। লক্ষ্য করার বিষয়, স্বাধীনতা-উত্তরকালে নাটকের নামকরণে যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছিল, সেলিম আল দীনও সে বৈশিষ্ট্য তাঁর নাটকে ধারণ করেছিলেন।
প্র : ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’ নাটকের বক্তব্য কী?
উ : প্রথমেই বলা দরকার রচনাকালে নাটকের নাম ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’ থাকলেও কয়েক বছর পর নাট্যকার এর নাম থেকে ‘ফ্যান্টাসি’ শব্দটি বাদ দেন। এই নাটকে বিশ শতকের আশির দশকের স্বৈরশাসকের কবল থেকে দেশের কিছুই যে রক্ষিত হচ্ছিল না, সেই চিত্র উপস্থাপিত। হাস্যরসের মাধ্যমে সেলিম আল দীন দেখিয়েছেন সেনা ও স্বৈরশাসকেরা দেশের প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে সঙ্গে শুভবোধ ও সংস্কৃতিকেও ধ্বংস করে।
প্র : ‘হাতহদাই’ নাটকের সম্পর্কে লেখ।
উ : বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে যে বিরাট সম্ভাবনা আছে ‘হাতহদাই’ এর উদাহরণ। নাটকটি নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষায় রচিত। ‘হাতহদাই’ নাম বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় ‘সাত সদাই’ বা সাত রকমের সওদা বা বহু কিছু। এই নাটকে নোয়াখালি অঞ্চরের এক গ্রামের মৌলবির মুখের আঞ্চলিক ভাষাও যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে সে কথা প্রতিষ্ঠিত।
প্র : সেলিম আল দীনের কোন নাটকের দীর্ঘ ব্যাপ্তি ছিল?
উ : ‘নিমজ্জন’ নাটকের ব্যাপ্তি। নাটকটি মঞ্চায়নের আগে যখন পাট করা হয় তখন এটা ছিল আট ঘণ্টা ব্যাপী। সেলিম আল দীনের ইচ্ছে ছিল নাটকটি পুরোটাই মঞ্চে রাখার। তাহলে মঞ্চ নাটকে একটিক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। গ্রাম থিয়েটার কর্তৃপক্ষ প্রথমে ভেবেছিলেন, তাই হবে। যে দিন নাটক মঞ্চায়ন হবে, সেদিন আট ঘণ্টায় কয়েকটা বিরতি দিয়ে তা সম্পন্ন করা হবে। বিরতির ফাঁকে খাবার ও ইনডোর বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু সব কিছু বিবেচনার পরে সে চিন্তা পরিত্যাগ করে নাটকটি দুই ঘণ্টায় নামিয়ে আনা হয়।
প্র : ‘ধাবমান’ নাটকের কাহিনি উল্লেখ কর।
উ : নেত্রকোনার বিরিশিরি-দুর্গাপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ও সোমেশ্বরী নদী এর আখ্যানের পটভূমি। বাঙালি ও গারোদের হাজার বছরের সংঘাত-যুদ্ধ-ধর্মান্তর প্রক্রিয়ার ব্যাপক অঘটনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে প্রান্ত এলাকায় বাসরত দুই জাতির মানুষের সমন্বয়ের ক্রিয়া, সম্পর্কসহ অবস্থানের প্রস্তুতি। এ সংস্কৃতি মানব প্রকৃতি ও জগতের প্রকৃত ছন্দরীতিতে নির্মিত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ লীন হয়ে যায় এ সংস্কৃতির ছন্দোময় স্রোতে। এর রকম প্রেক্ষাপটে সোহরাব নামের এক মহিষকে নিয়ে ধাবমান নাটকের ঘটনা গড়ে ওঠে। নাটকে দেকা যায়, নহবত-সুবতীর গৃহপালিত নারী-মহিষ (হামেলা) এক অপরাহ্নে নিখোঁজ হয়্ গর্ভবতী হয়ে হামেলা কদিন পর ফিরে আসে। গারোরা এই ভেবে আনন্দিত হয় যে, দেবতা তুষ্ট হয়ে আর এক দেবতা-মহিষ উপহাস হিসেবে পাঠাচ্ছেন। যথাসময় জন্ম নেয় এক মিশমিশে কালো মহিষ-শাবক ‘সোহরাব’। সোহরাব তার অঞ্চলে বলশালী ও যুদ্ধে অপরাজেয় মহিষ হিসেবে খ্যাতি পায়। নহবত-সুবতীর পঙ্গু সন্তান এছাক স্বপ্ন দেখে সোহরাবকে জবাই করে ভোজ দিলে তার পঙ্গুত্ব দূর হয়ে যাবে। নহবত-সুবতী সন্তানের আরোগ্য কামনায় সোহরাবকে উৎসর্গ করতে সম্মত হয়। কিন্তু জবাই হওয়ার পূর্ব-মুহূর্তে পালায় সোহরাব। নানা ভিটা ঘুরে অবশ্য আবার ফিরে আসে সোহরাব নামের মহিষ। অবশেষে খুন হওয়ার নিমিত্তে সোহরাব নিজের গলা বাড়িয়ে দেয় উদ্যত ছুরির নিচে।
প্র : ‘হরগজ’ কোন প্রেক্ষাপটে রচিত নাটক?
উ : মানিকগঞ্জ জেলার হরগজ নামক স্থানে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত প্রলয়সদৃশ টর্নেডোর অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৯২-এ সেলিম আল দীন ‘হরগজ’ নাটক লেখেন। টর্নেডো-পরবর্তী সর্বপ্রথম উদ্ধারপর্বে একটি ত্রাণের দলের দেখা প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের নানান স্তরে ছিঁড়েখেুঁড়ে ফেলার অভূতপূর্ব চিহ্ন এ নাটকের উপজীব্য। এতে প্রায় আণবিক বিস্ফোরণকল্প জড়ে অভিজ্ঞতায় তাদের ভ্রমণ শেষাবধি যেন হয়ে ওঠে আকৃতির জগত থেকে নিরাকৃত বিশ্বে অভিপ্রয়াণ।
প্র : ‘নিমজ্জন’ নাটকের কাহিনি কী?
উ : বিশ্ব-গণহত্যার ঘটমান কাহিনি ও দৃশ্যচিত্রের সমন্বয়ে ‘নিমজ্জন’-এর কাহিনি গড়ে উঠেছে। বিশ্ব পরিভ্রমণ শেষে এক আগন্তুক মৃত্যুশয্যায় শায়িত বন্ধুর কাছে আসবে বলে ত্রিনদীর মোহনায় গড়ে ওঠা এক শহরে এসে উপস্থিত হয়। বন্ধুটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। রাজনৈতিক মতবাদের জন্য ব্লাক ডেথ স্কোয়াড অব কারাভার লোকেরা নির্যাতনের পর তার মেরুদ-ে পেরেক ঠুকে দিয়েছিল। আগন্তুক ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে একে এক দেখতে পায় এক কুলির ঝুলন্ত লাশ, অদ্ভুতদর্শন এক বৃদ্ধ, স্টিমারে হলোকাস্ট, নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসা এক রূপসী নারী-তাকে যতবার কবরে শোয়ান হয় ততোবার সে মৃত্যু থেকে উঠে আসে। আগন্তুক বরফের ভেতরে একান্নটি শিশুর লাশ, আট কি নয় বছরের গায়িকা এক শিশুকে ধর্ষণের পর তার জিভ কেটে নেয়া, কান্দহারের মমি, মাদ্রিদের গণহত্যা, চিলির কবি পাবলো নেরুদার ফিন্দেমুন্দোর শোকগীতি, স্টেডিয়াম গ্যালারিতে প্রায় দেড় হাজার দর্শক ক্ষুরে কেটে খুন, ত্রিশ হাজার টন উচ্চক্শমতাসম্পন্ন টিএনটির বিস্ফোরণে ষোল কিলোমিটার পর্যন্ত বায়ুস্তরে আগুন ধরে যাওয়া শহরটির ক্রম নিমজ্জন দেখতে পায় এবং পরিশেষে সৌর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে এ নাট্যের অন্তিম সংলাপ ঘোষিত হয়।
প্র : ‘পুত্র’ নাটকের পরিচয় দাও।
উ : সেলিম আল দীন পুত্র হারানো এক দম্পতির অবিশ্রান্ত বিলাপ ও স্মৃতি মন্থরতা এ নাটকে রূপায়িত করেছেন। মাইটাল সিরাজ ও তার স্ত্রী যমুনা পারের আবছা। তাদের পুত্র মানিক আমগাছে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। নিয়মানুসারে ধর্মীয় কৃত্যহীন লাশ মাটিতে পুঁতে আমগাছটি কেটে ফেলা হয়। এ ঘটনার দুবছর পর এক শীতের রাতে উষ্ণতা পেতে এক দম্পতি আমগাছটির শিকড় দিয়ে আগুন জ্বালায়। এক দিকে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে আসতে থাকে আম গাছটির শিকড়, অন্য দিকে মা-বাবার অন্তরেপুত্র হারানোর যন্ত্রণা যেন দ্বিগুণ যন্ত্রণায় জ্বলতে থাকে। মৃতপুত্রের অপূরণীয় সব উচ্ছাস-আকাক্সক্ষাকে স্মরণ করতে করতে এক সময় গাছের শিকড়কেও পুত্র ভাবতে থাকে তারা। নাটকের শেষংশে দেখা যায়, নতুন সন্তানের তীব্র কামনায় স্ত্রী আবছা স্বামীকে তালাক দিয়ে পিলে যায় ফেলে আসা যমুনার তীরে।
প্র : ‘জুলান’ নাটকের পরিচয় দাও।
উ : উরুক গোত্রের অধিবাসীরাখরা আর অজন্মার মুখোমুখি। তাই তারা এলান পর্বতের ওপারে জুলান পর্বতে চলে যাবে। তাদের যেতে হবে জন্মভিটা ছেড়ে। সেই বেদনায় মন ভেঙে যায়। স্বপ্নময় চোখও জ্বলে সমান তালে। কিন্তু স্বপ্নে দেখেছে গোত্রতি পুরুত এক রজনী সম্ভোগান্তে তাকে বলি দেবে শামাসের উদ্দেশে। বজ্রাহতের মতো মুষড়ে পড়ে ইশতার ও প্রেমিক বীর গামেশ। কিন্তু গোত্রবাসীর কল্যাণার্থে প্রেমিকও উৎসর্গ করে প্রেমিকাকে। অতঃপর স্মৃতিতাড়িত হয় দুজন। প্রেমের দুর্নিবার টানে চেতনা জাগে মনে। বুঝতে পারে পুরুতের লাম্পট্য। পালাবে তারা, পালিয়ে যাবে দূরে, বহু দূরে- যেখানে শামাসের নির্দয় প্রত্যাদেশ নেই্ পুরুতের ভোগলিপ্সা, হানাহানি আর রক্তপাত নেই। প্রচ- বেগে ঘোড়া ছুটে চলে। হায়! ধুলোধুসর মরুপথে পুরুতের লোকেরাও তবে সেজেছে রণসাজে। অতঃপর গামেশ, ইশতার ও পুরুতের রক্তে বন্ধ হয়ে যায় জুলানের পথ।
প্র : নাট্যসাহিত্যে সেলিম আল দীন বিশিষ্ট কেন?
উ : তিনি তাঁর নাটকে নিজের গবেষণা ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে বাংলার লোকজ উপাদানকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চের পুরোনো ধ্যান-ধারণাকে ভেঙে দিয়েছেন। তাঁর শিল্পচিন্তার নাম ছিল ‘কথানাট্য’। প্রতিটি নাটকে কবিতা, গান, গল্প ও নাট্যের সম্বয় ঘটিয়েছেন সেরিম আল দীন। তিনি লোকজ উপাদানের সঙ্গে মিথ বা পুরাণকেও অসাধারণভাবে ব্যবহার করেছেন।
প্র : তিনি কোন কোন নাটক শেষ করে যেতে পারেন নি?
উ : ‘হাড়-হাড্ডা’ নামের একটি নাটক পরিকল্পনার মাত্র এক তৃতীয়াংশ তিনি লিখেছিরেন। সেটি সমাপ্ত করার আগেই সেলিম আল দীন মৃত্যুবরণ করেন।
প্র : তাঁর প্রথম প্রকাশিত বাংলা প্রবন্ধের নাম কী?
উ : ‘নিগ্রো সাহিত্য’। ১৯৬৮ সারে দৈনিক পাকিস্তান সাময়িকীতে প্রকাশিত।
প্র : টেলিভিশনে প্রচারিত সেলিম আল দীনের প্রথম নাটক কোনটি?
উ : ‘ঘুম নেই’। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে এই নাটক প্রচারিত হয়্ প্রযোজক ছিরেন আতিকুর হক চৌধুরী।
প্র : সেলিম আল দীন কী কী পুরস্কার পান?
উ : একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, জাতীয চলচ্চিত্র পুরস্কার, কথকথা সাহিত্য পুরস্কার, টেনাসিনাস পুরস্কার, নান্দীপট পদক ইত্যাদি।
প্র : তিনি কবে মৃত্যুবরণ করেন?
উ : ১৪ই জানুয়ারি ২০০৮। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।