Tuesday, October 8, 2024

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্

প্র : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ কবে, কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
উ : ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই অগস্ট চট্টগ্রামের ষোলশহরে।
প্র : তিনি কী হিসেবে পরিচিত?
উ :কথাসাহিত্যিক।
প্র : হাতে লেখা কোন পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেন, কখন?
উ : ফেনি স্কুলের ছাত্রাবস্থায় (১৯৩৬) ‘ভোরের আলো’ নামের পত্রিকা।
প্র : তাঁর প্রকাশিত প্রথম গল্পের নাম কী? কোথায় বের হয়?
উ : ‘হঠাৎ আলো ঝলকানি’। ঢাকা কলেজ ম্যাগাজিনে।
প্র : ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত তিনি কোন পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন?
উ : কলকাতার দৈনিক স্টেটস্ম্যান; সহকারী সম্পাদক পদে।
প্র : মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবস্থান কী ছিল?
উ : মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি প্রবাসে ইউনেস্কোতে কর্মরত থাকার সময় স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ার ক্ষেত্রে কাজ করেন।
প্র : তাঁর স্ত্রী কে?
উ : ফরাসি নাগরিক এ্যান মেরি (বিয়ে: ১৯৫৬)।
প্র : তাঁর রচনাসমূহ ক?ি
উ : উপন্যাস : লালসালু (১৯৪৮), চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪), কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮), দি আগলি এশিয়ান (ইংরেজি ভাষায়; রচনা ১৯৬৩)। গল্পগ্রন্থ : নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প (১৯৬৫)। নাটক : বহিপীর (১৯৬৫), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৬), সুড়ঙ্গ (১৯৬৪), উজানে মৃত্যু (১৯৬৬)।
প্র : ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্য সম্পর্কে কী বলা যায়?
উ : গভীর জীবনবোধ, অন্তর্লোকের রহস্য অনুসন্ধানসম্পৃহা ও সংস্কারকামী মনের অভিব্যঞ্জনায় তাঁর সাহিত্য ঋদ্ধ। তাছাড়া তিনি ব্যক্তিজীবন ও সমাজসমস্যার প্রেকষাপটে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার, মূল্যবোধের বিপর্যয়, মানসিক স্খলন ও পতনের আলেখ্য উজ্জ্বলভাবে অঙ্কন করেছেন।
প্র : লালসালু উপন্যাসের মূলবিষয় কী?
উ : ধর্ম নিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থকারীদের স্বরূপ উন্মোচন এবং নারী জাগরণের প্রেক্ষাপটে সমাজচেতনা।
প্র : ‘লালসালু’ উপন্যাস সম্পর্কে রেখ।
উ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচিত উপন্যাস। ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। এই উপন্যাসে একদিকে যেমন বাংলার গ্রামজীবনের বাস্তব প্রকৃতি ধরা পড়েছে তার সৌন্দর্য, মাধুর্য ও কঠোরতা নিয়ে; তেমনই রূপায়িত হয়েছে অসংখ্য গ্রামীণ মানুসের জীবন। নোয়াখালি অঞ্চল থেকে মজিদ নামের একটি কূটচরিত্র গারোপাহাড়ী অঞ্চলে গিয়ে সেই এলাকার মানুষকে ধর্মের নামে কীভাবে শোষণ করে, সেই বাস্তব চিত্র আছে উপন্যাসটিতে। ধর্ম ব্যবসায়ী মজিদ অর্থ ও প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে অল্পবয়সী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করে। সে গ্রামের মোড়লদেরও প্রভাবিত করে। পাশের গ্রামে অন্য পিরের আগমন হলে, নিজের দাপট খর্ব হবে বিবেচনায়, তাকে মারধর দিয়ে উচ্ছেদ করে। এদেশে মজিদের মতো চরিত্র আজো গ্রামে ও শহরে প্রচুর। তবে স্বল্পবয়সী স্ত্রী জমিলা কর্তৃক সে লাঞ্চিত হয়, মাজারের গায়ে পা লেগে থাকে জমিলার। উপন্যাসে জমিলা বিদ্রোহিনী, প্রতিবাদের প্রতীক। ‘লালসালু’র একটি বহুমাত্রিক ও কালোত্তীর্ণ উপন্যাস। উল্লেখযোগ্য চরিত্র : মজিদ, খালেক ব্যাপারি, জমিলা, রহিমা, আমেনা, আক্কাস, তাহেরের বাপ, হাসুনির মা। ঔপন্যাসিক ধর্মব্যবসায়ীদের উপলক্ষ করে লিখেছেন : ‘খোদার এলেমে বুক ভরে না তলায় পেট শূন্য বলে।’ উপন্যাসটি Tree Without Roots নামে অনূদিত হয়ে (১৯৬৭) খ্যাতি অর্জন করে।
প্র : লালসালুর ইংরেজি ানুবাদের নাম কী?
উ : ট্রি উইথ আউট রুটস্ (১৯৬৭)।
প্র : লারসালুর ফরাসি অনুবাদের নাম কী?
উ : ল্য অরবরে সামস মায়েমেঁ (১৯৬৪)।
প্র : কে উপন্যাসটির ফরাসি অনুবাদ করেন?
উ : ওয়ালীউল্লাহর পতœী অ্যান মেরি।
প্র : ‘চাঁদের অবাবস্যা’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪) উপন্যাসে আরেফ আলী নামের এক স্কুল মাস্টারকে অবলম্বন করে মানুষের অন্তর্জীবনের জটিলতা উল্লেখ প্রসঙ্গে সামন্ত-সমাজ প্রভাবিত গ্রামীণ জীবনের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন। গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য কাদের (যে গ্রামে দরবেশ বলে খ্যাত) গভীর রাতে এক যুবতীকে বাঁশঝাড়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ ও হত্যা করে। এই ঘটনা হঠাৎ দেখে ফেলে ওই পরিবারে আশ্রিত নিরুবিত্তের স্কুল শিক্ষক আরেফ আলী। এখন আরেফ কী করেবে? সে কি সবাইকে জানিয়ে দেবে সত্য ঘটনা? যদি জানায় তাহলে তার আশ্রয়চ্যুতি ঘটবে, নিজের উপরও চেপে যেতে পার সে অপরাধ! আর না বলেও সে মনে মনে অস্থির হয়ে যায়। আরেফের মনোগত ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াই এই উপন্যাসের মৌল প্রতিপাদ্য বিষয়্
প্র : ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের পরিচয় দাও।
উ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮) উপন্যাসে মুস্তফা, তবারক, খোদেজা, বদর শেখ, খেদমতুল্লা, কালু মিয়া ইত্যাদি চরিত্রের নামে গ্রামীণ ও কুমুরডাঙ্গার শাহরিক পরিবেশ বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু গ্রামের ছেলে মুস্তফা উচ্চশিক্ষা নিয়ে শহরে বিচারক পদে চাকরিকালে চাকরি ও পরিপার্শ্বের কারণে মানসিক দ্বন্দ্বে পতিত হয়। নিকটাত্মীয়া খোদেজা আত্মহত্যা করলে মুস্তফা ভাবে যে, মৃতের আত্মা তাকে অনুসরণ করছে। মুস্ফাও আত্মহত্যা করে। অন্যদিকে বাকল নদীতে চর পড়ায় ঘাটের টিকিট মাস্টার খতিব, ডাক্তার বোরহান, বাদশা, সকিনা, মোসলেহ উদ্দিন সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই উপন্যাসে ধর্মের নামে আচার-সর্বস্বতা, বিজ্ঞানের নামে অদৃষ্টবাদিতা, বাস্তবতার নামে স্বপ্ন-কল্পনা ইত্যাদির বিরুদ্ধাচারণ দেখা যায়। উপন্যাসে ব্যক্তির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুখ-দুঃখ নিয়ে সামষ্টিক অভিজ্ঞান রচিত হয়েছে। নদী হয়ে উঠেছে সামুহিক জীবনবাদী চেতনার প্রতীক। উপন্যাসে শুধু বিষয়চিন্তা নয় প্রকরণেও নতুনত্ব পরিদৃষ্ঠ হয়।
প্র : ‘দি আগলি এশিয়ান’ সম্পর্কে লেখ।
উ : উপন্যাসে পূর্ববঙ্গের রাজধানী শহর (নাম নেয়া হয় নি) কেন্দ্র করে রাজনীতিতে আমেরিকা হস্তক্ষেপ, সেনাবাহিনীকে দিয়ে সামরিক আইন জারি, সাধারণ মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার খর্ব করা, দেশে সাম্যবাদী উত্থান প্রচেষ্টা বাধ্যগ্রস্ত করা ইত্যাদি প্রধান হয়ে উঠেছে। সামরিক আইন জারি করিয়ে সেনাবাহিনী দিয়ে বা নিজেদের সমর্থনপুষ্ট পুঁজিবাদীদের কাজে লাগিয়ে মার্কিন দেশ তখন এশিয়ার প্রতিটি দেশেই নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত ছিল। এশিয়ার এই কদর্য রূপকেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসে নানাভি ও প্রধানমন্ত্রী কাদের শোষক শ্রেণির প্রতিনিধি ও মার্কিন সমর্থক। মার্কিন সাংবাদিক জনসনকে কাদের বলে যে, সে দেশে শিল্পায়ন চায় না। এতে মানুষ অধিকার সচেতন হয়ে উঠবে। কাদের কঠোর হস্তে গণতান্ত্রিক দাবির আন্দোলন থামায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের হত্যা করে। কিন্তু এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর ইচ্ছায় কাদেরকে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাদের আর একজন অনুগত মুতালিবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন দিলে সেনাবাহিনী তাকে মেনে নেয়্ মুতালিব প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশে সামরিক আইন জারি করে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহসান জেল খাটেন; তিন্নি নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীসহ অসংখ্য মানুষ এর নানামুখী প্রতিবাদ করে। উল্লেখ্য ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে এভাবেই আইয়ুব খান ক্ষমতা নিয়েছিরেন এবং ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে একইভাবে ইয়াহিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করেন। আসলে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দেই ওয়ালীউল্লাহ্ ১৯৭১-এর পূর্বপর্যন্ত বাঙালির সংগ্রামসমূহ এই উপন্যাসে ধারণ করেছেন শুধু তাঁর অন্ত র্দৃষ্টির গুণে। উপন্যাসটি চরমভাবে মার্কিনবিরোধী। উইলিয়াম জে লেডেরার ও ইউজিন বারডিক যৌথভাবে রচিত মার্কিন উপনাস ‘দি আগলি আমেরিকান’ (১৯৫৮) এর প্রভাব এ উপন্যাস রনার সময় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র উপর পড়েছিল।
প্র : ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পের পরিচয় দাও।
উ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর এই গল্পটি ‘দুটি তীর ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৬৫) গ্রন্থে সংকরিত হয়েছে। দেশভাগের সময় কলকাতা থেকে কিছু সংখ্যালগু মুসলমান এদেশে এসে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কদিনের মধ্যেই তারা জানতে পারে বাড়িটি এদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের পরিত্যক্ত। এ বাড়ির লোকেরাও প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে গেছে। বাড়িতে একটি তুলসী গাছ আবিষ্কার হয়্ এরকম কাহিনি নিয়েই গল্পটি সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। গল্পটির মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে মানুষের নিজস্ব জীবন যখন বিপন্ন ও অর্থহীন, তখন তার পরিপার্শ্বিক অনুষঙ্গসমূহও হয়ে পড়ে শুরুত্বহীন। দেখা যায় দেশবিভাগের নির্মম পরিণতিতে সর্বস্বান্ত মানুষের মানবিক মূল্যবোধও পরিস্থিতির কাছে জিম্মি।
প্র : তিনি কী কী পুরস্কার লাভ করেন?
উ : বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬১), আদমজি পুরস্কার (১৯৬৫), একুশে পদক (১৯৮৩)।
প্র : তাঁর মৃত্যু হয় কত তারিখে?
উ : ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর; প্যারিসে।

Related Articles

Latest Articles