বাঙালি একটি প্রাচীন জাতি। নানাবর্ণের জাতির গোত্রের মিশ্রণে বাঙালি জাতি গঠিত হয়েছে তাই বাঙালিকে সংকর জাতি বলা হয়। ঐতরেয় আরণ্যক অংশে বাঙালির কথা প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। যেখানে বঙ্গ এবং মঘধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে সকলে একমত নয়। ‘বোধায়ন ধর্মসূত্রে’ বঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। আর্যরা জনপদগুলিকে তিনভাগে ভাগ করে। এর মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট অংশে বঙ্গের ঊল্লেখ আছে। এই নিকৃষ্ট অংশে অস্থায়ীভাবে বাস করলেও প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। পুরানে পূর্বাঞ্চলীয় দেশের তালিকায় বঙ্গের নাম আছে। রামায়নে অযোধ্যার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনকারী দেশের তালিকায় বঙ্গের উল্লেখ রযেছে। এ থেকে বোঝা যায় বঙ্গের মানুষ তখন অস্পৃর্শ বা বর্বর ছিলো না। মহাভারতে বলা হয়েছে, বঙ্গ পূর্বাঞ্চলীয় একটি দেশ এবং এটি ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিমে অবস্থিত। কালিদাসের রঘুবংশে বঙ্গকে গঙ্গাস্রোতের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে চর্যাপদে বাঙালির কথা বলা হয়েছে। বাঙালি আর্য জাতি নয় তারা অনার্য। অর্থাৎ তারা ছিলেন এদেশীয়। বাঙালি আদি অষ্ট্রলয়েড গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হয়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, অষ্ট্রিক জাতীয় লোকরাই ভারতে প্রথমে সংঘবদ্ধ সুসভ্য জীবনের পত্তন করে। পন্ডিতদের মতে, বর্তমান বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চল পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। তখন এ অঞ্চল কি নামে পরিচিত ছিল তা জানা যায় না। তবে এ অঞ্চলে বিভিন্ন নরগোষ্ঠির আগমন ঘটেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার প্রমাণ আমাদের নানা রকমের চেহারা। বাংলার আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতাল, কোচ, লোধা প্রভৃতি জাতের লোক এখনো দৃষ্ট হয়। প্রাচীন আর্য সাহিত্যে এদের ‘নিষাদ’ বলা হয়েছে। বাঙালিরা বহু আগে থেকেই বর্ণ সংকর জাতিতে পরিণত হয়। হিন্দু ও বৌদ্ধ আমলেও এদেশে খাঁটি আর্যরক্ত ছিলো না। এখানে শুধু রক্তের মিশ্রণ ঘটেনি এ্যানিমিজম, প্যানথিজম, প্যাগানিজম, বৌদ্ধমত প্রভৃতির সমন্বয়ে একটি লোকধর্মও তৈরি হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-
‘কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে
কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এর কোথা হতে
সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথায় অনার্য
হেথায় দ্রাবিড় চীন-
শকহুনদল পাঠান মোগল
এক দেহে হল লীন।’
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বেশ প্রাচীন। বাংলা ভাষা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভাষা পরিবার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্যতম ভাষা। ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষাসমূহের মধ্যেও এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষা। বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সাহিত্য চর্যাপদ। এটি মূলত কবিতা। তবে তা গানের বৈশিষ্ট্যও ধারণ করে। বৌদ্ধ সাধকগণ এটি রচনা করেন বলে অনুমান করা হয়। যদিও ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও অন্য পন্ডিতগণ বিশ্বাস করেন ও যুক্তি দেখিয়েছেন যে, চর্যাপদের ভাষা বাংলা তবে অন্য দু’একটি ভাষার পÐিতেরা এটিকে তাঁদের ভাষায় রচিত বলে দাবী করেন। বাংলা ভাষা গৌড়ীয় প্রাকৃত বা মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলে ভাষাতাত্তি¡কেরা অনুমান করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন, বাংলা ভাষার পূর্বে যে ভাষা ছিল তার নাম গৌড় অপভ্রংশ বলা যায়। প্রাকৃত বৈয়াকরণ মার্কন্ডেয় ২৭টি অপভ্রংশের মধ্যে গৌড় অপভ্রংশের নাম করেছেন। কাহ্ণের ও সরহের দোহাকোষে এবং প্রাকৃতপিঙ্গলে গৌড় অপভ্রংশের কিছু নিদর্শন রয়েছে। গৌড় প্রাকৃতের পূর্বে ছিল গৌড়ী প্রাকৃত। দন্ডী (আনুমানিক ৬০০ খ্রীষ্টাব্দে গৌড় প্রাকৃতের নাম উল্লেখ করেছেন। ভাষাতত্তে¡র বিচারে গৌড় অপভ্রংশ হতে প্রথমে বিহারী উৎপন্ন হয়ে যায়, তারপর উড়িয়া, তারপর বঙ্গকামরূপী ভাষা। বঙ্গকামরূপী পরে বাংলা ও আসামীতে পরিণত হয়েছে।
উপমহাদেশের আর্য ভাষার সবচেয়ে প্রাচীনতম বর্ণমালার সন্ধান পাওয়া যায় রাজা অশোকের অনুশাসনের সময় খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। বগুড়ার মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত লিপির সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এই লিপিই হলো ব্রাহ্মী লিপি। খ্রীস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর দিক স্থানভেদে ব্রাহ্মী লিপির বির্বতনগত হতে থাকে- পশ্চিমা লিপি, মধ্যভারতীয় লিপি ও পূর্বী লিপি। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্রাহ্মী অক্ষর থেকে পূর্বভারতের সব লিপির জন্ম হয়েছে। অষ্টম শতকের কাছাকাছি সময়ে পূর্ব ভারতের লিপির নিজস্ব রূপ ফুটে উঠেছে। অনেকে মনে করেন, নাগরী লিপি বাংলা লিপির চেয়ে পুরনো। একথা ঠিক নয়।